কারও মুখাপেক্ষী হতে চাই না: সিদ্দিকুর

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: দুই হাত আর মুখটি ছাড়া পুরো শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। বিছানায় শুয়ে ডান হাত দিয়ে কালো মুঠোফোনের বাটনগুলো টিপে যাচ্ছিল। চেষ্টার কারণ একটি, যেন কারও সাহায্য ছাড়া প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

 

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়তলার কেবিনে এই চেষ্টা কেবল একবার-দুবার নয়, সময় পেলে করেন সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। আজ সোমবার দীর্ঘ সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথা বলার একপর্যায়ে সিদ্দিকুর রহমানের কাছে এর কারণ জানতে চাওয়া হয়। তখন একচিলতে হাসি ছড়িয়ে তিনি বলেন, ‘ভাই, আমি কারও মুখাপেক্ষী হতে চাই না। কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। জীবনের বাস্তবতা মেনে নিয়েছি। আমাকে তো বাঁচতে হবে। তাই নিজের শক্তিতে বেঁচে থাকতে চাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের পরীক্ষার তারিখ ও সময়সূচি ঘোষণার দাবিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে আন্দোলনে গিয়ে ‘পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলের’ আঘাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিদ্দিকুরের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই দিনই তাঁকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর দুই চোখে অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকেরা বলেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখের দৃষ্টি নেই। বাঁ চোখে এক দিক থেকে আলো ফেললে আলোর উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। দৃষ্টি ফেরার ‘ক্ষীণ’ আশা আছে। ২৭ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সিদ্দিকুরকে চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়।
চেন্নাইয়ের হওয়া চিকিৎসা নিয়েও কথা হয় সিদ্দিকুরের সঙ্গে। তিনি জানান, পরের দিন চেন্নাইয়ের চিকিৎসক ধনশ্রী রাত্রা সিদ্দিকুরের চোখ পরীক্ষা করে বলেন, চোখের ভেতরের আঘাত গুরুতর। অস্ত্রোপচারে যাওয়া ঠিক হবে কি না, এ জন্য তিনি দ্বিতীয় মতামতের জন্য চিকিৎসক লিংগম গোপালের কাছে পাঠিয়ে দেন। লিংগম গোপাল তাঁর মতামতে বলেন, অস্ত্রোপচারেও সিদ্দিকুরের চোখের দৃষ্টি ফিরবে না। তবে সিদ্দিকুরের সম্মতি থাকায় শেষ চেষ্টা হিসেবে ৪ আগস্ট তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়।
জীবনের এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখানেই জীবনযুদ্ধ হার মানতে রাজি নন সিদ্দিকুর। তাই মুঠোফোনে শুধু নিজের স্বজনদের খুঁজে বের করার চেষ্টাই করছেন না তিনি। পাশাপাশি সিদ্দিকুর নিজে নিজেই খাবার খাওয়া, পোশাক বদল করা, কেবিনের ভেতর হাঁটা-চলা করছেন। খাওয়ার সময় যদি মাছ থাকে, তখন এর কাঁটাও বেছে নেন তিনি।
কালো সানগ্লাস চোখে দিতে দিতে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমি জীবনে কারও ওপর ভরসা করে চলিনি। যখন দেখতে পেতাম, তখনো না। ভবিষ্যতেও করব না।’
এখন সময় কীভাবে কাটে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, নিজের উপার্জনের পথ বের করা, ঘুরে বেড়ানো বেশ উপভোগ করি। কিছু দেখতে এখন পাই না। তবে গল্প করছি। আয়ের কথা ভাবছি। আমাকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকায় ফিরে এসে এ বিষয়ে আর কিছু শুনিনি।’
চোখের অবস্থা সম্পর্কে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শুধু দেখতে পাওয়া ছাড়া আমার দুই চোখের অবস্থা ভালো আছে। চেন্নাইয়ে বাঁ চোখে অপারেশনের পর খুব সামান্য ব্যথা হয়েছিল। এখন সেটাও নেই। ঠিকমতো খাবার খাচ্ছি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

সিদ্দিকুরের সঙ্গে থাকা তাঁর বন্ধু বেলায়েত হোসেন জানান, চেন্নাই থেকে ফিরে আসার পর শনিবার পেটের পীড়ায় ভুগেছিলেন সিদ্দিকুর। তখন তাঁর শরীরটা বেশ দুর্বল হয়েছিল। রোববার সন্ধ্যার দিক থেকে পেটের পীড়া আর নেই।
সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও ঢাকাতেই আপাতত থাকবেন সিদ্দিকুর। এ কথা জানিয়ে বেলায়েত হোসেন বলেন, চাকরি বা আয়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সিদ্দিকুরকে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে রাখা হবে। ওকে কোনোভাবেই একা রাখা হবে না। একা থাকলে সিদ্দিকুর মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে।
খাটের সঙ্গে গাল লাগিয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন সিদ্দিকুরের মা সুলেমা খাতুন। একসময় তিনি নিজেই বলে ওঠেন, ‘আমার পোলার রাগ কম। এত কষ্টে আছে। তারপরও হাসিমুখে কথা কয়। ওর লইগা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখছি।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ