নদী রেহাই দিলেও বাঁচল না বিদ্যালয়ের দালানটা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর চর বাউশার একটি তিনতলা সরকারি বিদ্যালয় ভবন ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংগঠনগুলোর দুটি পক্ষ। চলতি আগস্ট মাসের শুরুতেই ভাঙার লক্ষ্যে বিদ্যালয় ভবনটি নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় চৌহালী উপজেলা প্রশাসন। মাত্র ৬৫ হাজার টাকা নিলামমূল্যে ভবনটি তুলে দেওয়া হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল বিএসসির কাছে। কিন্তু গত শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে যমুনার এই প্রত্যন্ত চরে সরেজমিনে দেখা যায় অন্য পরিস্থিতি।
গত বৃহস্পতিবার দরজা-জানালা সব খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে শ্রমিকেরা ভাঙছিলেন দেয়াল ও ছাদ। সেখানে ভাঙনের কাজ তদারক করছিলেন চৌহালী উপজেলার উমরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সানোয়ার সর্দার। তিনি জানান, অন্যায়ভাবে এলাকাবাসীর সম্পত্তি ভেঙে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গতকাল। আজ এলাকাবাসী বাকিটা ভেঙে নিচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইজারা গ্রহণকারী হেলাল বিএসসি নন, যাঁরা ভাঙছেন, তাঁরা স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের মাসুদপক্ষ নামে পরিচিত। তাঁদের যুক্তি, অন্যায়ভাবে বিদ্যালয়টি ভাঙা হচ্ছিল; তাই তাঁরা হস্তক্ষেপ করেছেন। বাইরের লোক যাতে ভাঙতে না পারে, তাই তাঁরা নিজেরাই ভাঙার দায়িত্ব নিয়েছেন।
জায়গাটা সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার অন্তর্গত। সিরাজগঞ্জ বা টাঙ্গাইলের স্থলভূমি থেকে এখানে আসতে যেকোনো সাধারণ ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। এত দুর্গম এলাকার এটিই একমাত্র পাকা বিদ্যালয়।
চৌহালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিদ্দিকুর রহমান জানান, উপজেলার এ-বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যালয় ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। ৬৫ হাজার টাকার নিলামমূল্যে দায়িত্বটি পান উমরপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেলাল বিএসসি। তিনি জানান, বিদ্যালয়টি ভাঙা দরকার বলে এক মাস আগে আবেদন করেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান। এরপর কমিটি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্যালয়টি নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর এ অংশে এক মাস আগে বন্যার প্রকোপ না থাকা অবস্থায় কেন বিদ্যালয়টি আগাম ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো—এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি ইউএনও। তিনি জানান, এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী প্রকৌশলীর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী প্রকৌশলীর ব্যাখ্যা হলো, ‘জুলাই মাসে প্রথম বন্যার সময়ই বিদ্যালয়টি ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’ যেহেতু প্রধান শিক্ষক আবেদন করেছিলেন, সেহেতু তড়িঘড়ি করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ইউএনও ও উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী উভয় এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ৬৫ হাজার টাকায় বিদ্যালয় স্থাপনা বিক্রি করা লাভজনক হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিবেদনে স্থাপনার মূল্য ঠিক করা হয়েছিল মাত্র ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে তাঁর থেকে ৫০০ টাকা বেশি মূল্যে, অর্থাৎ, ৬৫ হাজার টাকায় এর নিলাম সম্পন্ন হওয়ায় এটা লাভজনকই হয়েছে।
কিন্তু বিদ্যালয়টির পাশে উপস্থিত চরবাসী কৃষক রওশন মণ্ডল ও রবিউল জানান, এক মাস আগে কিংবা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে যমুনা নদীর চর বাউশা অঞ্চলে ভাঙন দেখা যায়নি। অথচ ইউএনও ও উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী দাবি করেন, বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে ফেলা সিদ্ধান্তটি যখন নেওয়া হয়, তখন নদী বিদ্যালয়টির মাত্র ১০ থেকে ১৫ ফুট দূরে ছিল। কিন্তু শুক্রবার বিকেলে চলে আসার সময়ও যমুনা নদীকে বিদ্যালয়টির সামনের দিকে প্রায় ১০০ ফুট দূরে নদী বইতে দেখা যায়। ভবনটির নিচের তলার ফাঁকা অংশ তিন ফুট পানির নিচে ডুবে ছিল। এর উত্তরেও নদী ছিল দেড় শ ফুট দূরে।
চৌহালী উপজেলার বন্যাক্রান্ত এলাকাটি শুক্রবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘুরে দেখা যায়, ভাঙনের কবলে পড়া গ্রামবাসী টিনের ঘর খুলে বড় বড় নৌকায় করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এক মাস বা পনেরো দিন আগে নয়, ভাঙন মাত্র গত সপ্তাহের শুরুর ঘটনা বলে তাঁরা জানান।
এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান নঈম গওহর ওয়ারা বলেন, সিরাজগঞ্জ এলাকায় শুরুতে ভাঙনের ঝুঁকি ছিল না। ভাঙন মাত্র তিন দিনের ঘটনা।
বিদ্যালয়টি নিলামে তোলা বিষয়ে সেখানে উপস্থিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সানোয়ার সর্দার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার হেলাল বিএসসির লোকজন স্কুল ভাঙতে এলে আমরা কাগজ দেখতে চাই। তারা বলে নিলাম হইছে, কিন্তু কাগজ দেখাইতে পারে নাই। আমরা আপত্তি করলেও তারা স্কুলের লোহার জানালা-দরজা, চৌকাঠ, চেয়ার-টেবিল-আলমারি সব নিয়ে যায়।’
তাঁর সঙ্গে একই নৌকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘যারা ভাঙতে আইছিল, তারা আওয়ামী লীগের সাংসদ আব্দুল মজিদ মণ্ডলের লোক। অরা মণ্ডল গ্রুপের লোক।’ নিজেদের তাঁরা আওয়ামী লীগের নেতা লতিফ বিশ্বাস গ্রুপের সমর্থক বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তারা তাদেরটা ভাঙছে, আমরা আমাদেরটা ভাঙতেছি।’ বিষয়টির সুরাহা করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের বাড়িতে দুই পক্ষ সে সময় বৈঠক করছে বলে জানান আওয়ামী লীগের এই তৃণমূল নেতা। কিন্তু এই প্রতিবেদক শুক্রবার সন্ধ্যায় কয়েক দফা ফোন করেও ইউপির চেয়ারম্যান আবুল মতিন সরকারের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নিলামে ইজারা দেওয়া হলো একজনকে, কিন্তু বিদ্যালয় ভাঙছে আরেকজন—এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ইউএনও এবং সহকারী প্রকৌশলী উভয়ই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন বলে জানান।
ইউএনও সিদ্দিকুর রহমান উপজেলার আট-নয়টি গ্রাম বন্যায় সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে বলে জানালেও একটি গ্রামেরও নাম বলতে পারেননি। বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই বলে তিনি জানান। তবে এ বিষয়ে যে কমিটি রয়েছে, তিনি এর সভাপতি। অন্য সদস্যরা হলেন উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক।
এ বিষয় জানার জন্য ফোন করা হলে শুক্রবার সন্ধ্যায় উমেরপুরের চর বাউশা ৫১ নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে ভাঙা শুরু হওয়ার ৪ দিন পর আবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনতলা স্কুলটির নিচ থেকে বন্যার পানি কমে গেছে এবং ভাঙনও ১০০ ফুট দূর থেকে আর এগোয়নি। এ অবস্থায় বিদ্যালয়টি ভাঙার কোনো যুক্তি নেই বলে গতকাল সকালে মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকে বলেন সানোয়ার সর্দার।