সাত খুনের পূর্বাপর

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তিন বছর আগে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। একসঙ্গে সাত–সাতটি মানুষকে অপহরণের পর ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সাত খুন মামলায় আজ মঙ্গলবার রায় দিচ্ছেন হাইকোর্ট। এই প্রেক্ষাপটে সাত খুনের পূর্বাপর জানতে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।

অপহরণ-খুন-গুম
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন।

৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ, পরদিন মেলে আরেকটি লাশ।

হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যরা হলেন নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করেন। আর আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এই মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ।

র‍্যাবের সম্পৃক্ততা
সপ্তাহ খানেকের মাথায় এই ঘটনায় র‍্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা-সদস্যের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ পায়। টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগ ওঠার পর র‍্যাব-১১-এর তৎকালীন তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম মাসুদ রানাকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত নেওয়া হয়। তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পরে হাইকোর্টের নির্দেশে তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম মাসুদ রানাকে সাত খুন মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

তিন কর্মকর্তার জবানবন্দিতে র‍্যাব-১১-এর অন্যান্য সদস্যের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এলে পর্যায়ক্রমে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

নূর হোসেন-শামীম ওসমান কথোপকথন
ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত নূর হোসেনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের একটি টেলিকথোপকথন প্রকাশ পায়। নূর হোসেন ভারতে পালাতে শামীম ওসমানের সহায়তা চান। পরে নূর হোসেন পালিয়ে ভারতে যান। একপর্যায়ে কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন নূর হোসেন। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় ভারত।

অভিযোগ গঠন
২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল র‍্যাবের ২৫ জন (চাকরিচ্যুত) কর্মকর্তা-সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। সাত মাসে ৩৮ কর্মদিবসে মামলার কার্যক্রম ও শুনানি চলে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন।

নিম্ন আদালতের রায়
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সাত খুন মামলার রায় দেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত। রায়ে র‍্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা-সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তাঁর অপরাধজগতের ৯ সহযোগীসহ মোট ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া র‍্যাবের আরও নয়জন সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। তাঁরা হলেন সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, নূর হোসেনের সহকারী সানাউল্লাহ ও শাহজাহান।

১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, করপোরাল মোখলেছুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেন। শেষ দুজন পলাতক।

ডেথ রেফারেন্স ও আপিল
বিচারিক আদালতের রায় ও নথি গত ২২ জানুয়ারি হাইকোর্টে পৌঁছায়, তা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুই মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা। শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি।
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৩৫ আসামির মধ্যে ২৮ জন আপিল করেন।
পরে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গত ২২ মে শুনানি শুরু হয়। ৩৩তম দিনে ২৬ জুলাই শুনানি শেষ হয়। রায়ের জন্য ১৩ আগস্ট দিন রেখেছিলেন আদালত। ১৩ আগস্ট রায়ের তারিখ পিছিয়ে ২২ আগস্ট নতুন তারিখ ধার্য করেন একই বেঞ্চ।সাত খুন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের দেওয়া দণ্ড হাইকোর্টে বহাল থাকবে কি না, সে সিদ্ধান্ত আজ মঙ্গলবার জানা যাবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ