বাপ্পারাজ কাঁদালেন
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাবা হারানোর বেদনায় সন্তান কাঁদবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাপ্পারাজও কাঁদলেন, সবাইকে কাঁদালেনও। তবে আজ দুপুরে এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরে সদ্য প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাকের ছেলের অশ্রুসজল চোখে ছিল বেদনার চেয়েও আরও বেশি কিছু। ছিল ক্ষোভ, আকুতি এমনকি আর্তনাদও। গত বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে যে সংকট, সেটির প্রসঙ্গ টেনে মঞ্চের সামনে বসা সবার প্রতি বাপ্পা অনুরোধ জানান, অন্তত তাঁর প্রয়াত বাবার কারণে হলেও যেন চলচ্চিত্রের এই অচলাবস্থার অবসান হয়।
২১ আগস্ট সোমবার না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা ‘নায়করাজ’ রাজ্জাক। তাঁর স্মরণে শনিবার এফডিসিতে শোকসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার।
এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরে দর্শক আসন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। শুরুতে বাপ্পারাজ বক্তৃতা দিতে এলে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে ফ্লোরে। বক্তব্যের শুরুতে সন্তান হিসেবে নিজ বাবা সম্পর্কে মানুষের কিছু ভুল ধারণা আর সমালোচনার জবাব দেন একসময়কার জনপ্রিয় এ নায়ক। রাজ্জাক সমন্ধে কিছু ব্যাপারে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণাকে ভুল হিসেবে বলে বিষগুলো ব্যাখ্যা করেন তিনি। বক্তব্যের একপর্যায়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের চলমান জটিলতা নিয়ে ইঙ্গিত করে বাপ্পারাজ বলেন, ‘আমিও হয়তো ভুল করে অনেক কথা বলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি ভুল করেছি, এ জন্য নোটিশ পাঠানোর দরকার নেই। শাকিব ভুল করেছে, এ জন্য বয়কট করার দরকার কী? শাকিবকে ডাকলে শাকিব আসবে না কেন?’
এ সময় বাপ্পার কণ্ঠে ঝরেছে শঙ্কা আর অভিমান, ‘এ অবস্থা চলতে থাকলে চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা আমরা কখনোই চাই না। যদি আপনারা সব নিষেধাজ্ঞা, মামলা তুলে না নেন, আমি আর কখনোই এফডিসিতে আসব না। হয়তো এটাই হবে আপনাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা।’
বাপ্পারাজের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন অভিনেতা আলমগীর। জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবার আগে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়েছিলেন। আলমগীর বলেন, রাজ্জাককে কখনো বাবা, কখনো পথপ্রদর্শক আবার কখনো সহশিল্পী হিসেব দেখেছেন। নায়করাজ সমন্ধে তাঁর ভাষ্য, ‘রাজ্জাক ভাই আমাকে প্রতিকূল আবস্থায় পাখির মতো উড়তে শিখিয়েছেন।’ এ সময় বাপ্পারাজকে উদ্দেশ করে আলমগীর বলেন, ‘বাপ্পাকে বলছি, আমাদের চলচ্চিত্র পরিবার এক থাকবে। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হতে পারে, দ্বন্দ্ব হতে পারে, এমনকি মারামারিও হতে পারে। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, এই দ্বন্দ্ব যত দ্রুত সম্ভব আমরা মিটমাট করব। এই চলচ্চিত্রকে নিয়ে রাজ্জাক ভাই যে স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করব। এটা কথা দিলাম।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুকও সব দ্বন্দ্ব দূর করে জটিলতা নিরসনের আশ্বাস দিলেন। নাম উল্লেখ না করে তিনি অনুপস্থিত শিল্পীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ফারুক বলেন, ‘চলচ্চিত্র পরিবার গঠিত হওয়ার আগে রাজ্জাক ভাই আমাকে একদিন ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, ফারুক এফডিসিতে আবার কী হচ্ছে? তুই একটু দেখনারে ভাই! আমি বলেছিলাম, এত বড় দায়িত্ব আমার পক্ষে একা নেওয়া সম্ভব না ভাই। তারপরও তিনি আমাকে এই দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। আমি নিয়েছি।’
নায়করাজকে ‘বড় ভাই’ হিসেবে উল্লেখ করে ফারুক বলেন, ‘তাঁকে সবাই নায়করাজ, মহানায়ক এসব উপাধি দিয়েছেন। কোনোটাই মিথ্যা নয়। কিন্তু আমার কাছে তিনি আমার ভাই, আমার বড় ভাই ছিলেন। আমার আর তাঁর মধ্যে যে সুন্দর-সুসম্পর্ক ছিল, সেটা তাঁর বাড়ির মানুষও জানতেন না। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল, সেটা অনস্ক্রিনে। স্ক্রিনের বাইরে আমরা ছিলাম খুব ঘনিষ্ঠ। আমি সব সময় তাঁকে সম্মান করেছি।’
শুরুতে বাপ্পারাজের কান্না আর ক্ষোভ শোকসভার অনেকের মাঝেই সংক্রমিত হয়। নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘বেহুলা’র নায়িকা সুচন্দাও স্মৃতিকাতর হন। সুচন্দা বলেন, ‘রাজ্জাক ছিলেন এক সহজাত অভিনেতা, যে চরিত্র করতেন খুব সহজেই মানিয়ে যেতেন। আমরা একসঙ্গে অনেকবার পর্দা ভাগাভাগি করেছি। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দিনের পর দিন এফডিসিতে পড়ে থাকতে হয়েছে আমাদের।’ রাজ্জাক সমন্ধে তাঁর উক্তি, ‘নায়করাজ এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর সম্পর্কে কথা কখনোই শেষ হবে না। উনি বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা, আমার চোখে মহানায়ক। তাঁর দেখানো পথে বাংলাদেশের সব নায়ক পথ চলবে, এটাই প্রত্যাশা করি।’
বর্তমান চলচ্চিত্রশিল্পের মন্দা অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন কুমার ঘোষ। অভিনেতা সোহেল রানা তাঁর বন্ধু রাজ্জাককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি চলে গেলেও আমাদের মনের রাজ্যে বিরাজ করবে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র যত দিন থাকবে, তোমার নাম তত দিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যেখানেই থাকো ভালো থেকো। স্রষ্টা যেন তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।’
একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিচারণা বই প্রকাশ করার পরামর্শ দিলেন রাজ্জাকের সঙ্গে অনেক কাজের সঙ্গী আমজাদ হোসেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে ‘কমপ্লিটম্যান’-এর (পরিপূর্ণ মানুষ) সংখ্যা খুব কম। রাজ্জাককে ‘সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ’ উল্লেখ করে আমজাদ হোসেন বলেন, এখন তো মনে পড়ছে, ভবিষ্যতে রাজ্জাককে আরও বেশি করে মনে পড়বে, পড়তে বাধ্য।’
রাজ্জাককে একজন শিক্ষক ও সবার অভিভাবক মন্তব্য করে চিত্রনায়িকা রোজিনা বলেন, ‘এফডিসিতে একটা স্ট্যাচু, আর একটা ফ্লোরের নাম যেন রাজ্জাকের নামে করা হয়। আমি এই দাবি জানাচ্ছি। যদিও রাজ্জাক সাহেবের অবদানের কাছে এটুকু নিতান্তই নগণ্য, তবু এফডিসিতে পা রেখে তাঁর সম্মানে নত হতে চাই। সে জন্য এটুকু দাবি আমার রইল।’
রাজ্জাক ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্প সমিতির প্রথম সভাপতি। সমিতির বর্তমান সভাপতি মিশা সওদাগর তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে প্রথম দিককার স্মৃতিচারণা করে বলেন, একজন পূর্ণ আধুনিক ও সামাজিক মানুষ ছিলেন রাজ্জাক ভাই। মানুষকে যথাযথ সম্মান করতে জানতেন। কে সিনিয়র, কে জুনিয়র—এসব বৈষম্য করতেন না। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থার নবনির্বাচিত সভাপতি আবদুল লতিফও স্মৃতিচারণায় রাজ্জাকের সব মানুষকে এক কাতারে দেখার গুণের কথা উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে ব্যক্তি রাজ্জাক ও নায়ক রাজ্জাক নিয়ে আরও স্মৃতিচারণা করেন সুজাতা, চম্পা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক কাজী শোয়েব রশীদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (বাচসাস) সভাপতি আবদুর রহমান, পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, ফিল্ম এডিটর গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা, চলচ্চিত্র প্রযোজক খোরশেদ আলম প্রমুখ। বিভিন্ন সময়ে শোকসভার সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস, জায়েদ খান ও পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন।
নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি আড়াই ঘণ্টায় শেষ হয় দোয়ার মধ্য দিয়ে। তার আগে শেষ বক্তা হিসেবে আগতদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাবার জন্য দোয়া চান চিত্রনায়ক সম্রাট।