একজন সাকিব না থাকলে কী হতো !

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: মিরপুর টেস্টে তৃতীয় দিনের বিকেলটা ছিল বিষণ্ন। সে বিষণ্নতা কেটে গিয়ে আজ মিলল আলোর দেখা। সে আলো জয়ের, যার অন্য নাম হতে পারে সাকিব-আলো!

চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে জয় থেকে ১৫৬ রানের দূরত্বে ছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে তারা অলআউট হয়েছে ২৪৪ রানে। চতুর্থ দিনে ১৩৫ রানে বাকি ৮ উইকেট পড়েছে অস্ট্রেলিয়ার—চারটিই সাকিবের। ঢাকা টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ২০ উইকেটের অর্ধেকই সাকিবের শিকার। ২০ রানের দুর্দান্ত জয়কে তাই ‘সাকিব-আলোয় উদ্ভাসিত’ না বলে উপায় আছে!
আজ সকালের কথাই ধরুন, উইকেটে জমে গিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার ও স্টিভেন স্মিথ। জয় দূর অস্ত, লড়াই করার মানসিকতাই যখন মিইয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, সাকিব আল হাসান তখন হাঁটলেন স্রোতের বিপরীতে; ওয়ার্নারকে ফেললেন লেগ বিফোরের ফাঁদে। এর তিন ওভার পর আবারও সাকিবের আঘাত। এবার তাঁর শিকার স্মিথ; জয়ের পথে সবচেয়ে বড় কাঁটা। সেই কাঁটা উপড়ে সাকিব সতীর্থদের দেখিয়ে দিয়েছেন, এখান থেকেও ফেরা যায়।
সাকিবের এ দেখানো পথে হেঁটে হ্যান্ডসকম্বকে তুলে নেন তাইজুল। ঠিক দুই ওভার পরই সাকিবের শিকার ম্যাথু ওয়েড। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেটে ১৯২। ম্যাক্সওয়েল ও অ্যাগারের ব্যাটে এখান থেকে লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু দুজনই দ্রুত ফিরেছে ড্রেসিংরুমে। প্রথমে ফিরলেন অ্যাগার, তাইজুলকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। তাই স্কোরবোর্ড বলছে, অ্যাগার তাইজুলের শিকার। আসলেই কি?
অ্যাগারের আউটের মুহূর্ত আরেকবার ফিরে দেখা যাক। মধ্যাহ্নবিরতির একটু আগে কিছুটা আলগা বোলিং করছিলেন তাইজুল। ওভারের মাঝপথে তাই তাইজুলকে আলাদা করে ডেকে নিলেন। হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এভাবে নয়, ওভাবে। এখানে নয়, ওখানে। লেগ স্ট্যাম্পের লাইনে বোলিংয়ের কারণে ম্যাক্সওয়েল-অ্যাগার অযথাই কিছু সিঙ্গেলস পেয়েছেন। ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপ বাড়াতেই তাইজুলকে উপায় বাতলে দিলেন। ফলটা এল হাতেনাতে। তাইজুলের সেই ওভারের শেষ বলেই আউট অ্যাগার! অফস্টাম্পের কিছুটা বাইরের পিচ করে বলটা কিছুটা থেমে এসেছে অ্যাগারের ব্যাটে। আর অফসাইডে শট খেলতে বাধ্য হওয়ায় টাইমিংয়ে গড়বড় করে অ্যাগার তাইজুলের তালুবন্দী।

ঢাকা টেস্টে সাকিবের যত অর্জন:
* টেস্টে দ্রুততম সময়ে ৩৫০০ রান ও ১৫০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি।
* স্যার রিচার্ড হ্যাডলির পর টেস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে একাধিক ম্যাচে ১০ উইকেট ও হাফসেঞ্চুরি।
* চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ইনিংসে ন্যূনতম ৫ উইকেটশিকার।
* প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে ১০ উইকেট নেওয়ার সঙ্গে ন্যুনতম অর্ধশত রানের ইনিংস।

ঢাকা টেস্টের সবুজ গালিচায় সাকিব-বন্দনার এখানেই শেষ নয়। মধ্যাহ্নবিরতিতে সাকিব কী চোখ রেখেছিলেন অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমে? হাতে ৩ উইকেট নিয়ে জয় থেকে অস্ট্রেলিয়া তখনো ৬৬ রানের দূরত্বে। উইকেটে ছিলেন ম্যাক্সওয়েল, যাঁকে ধরা হয় বর্তমান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হিসেবে। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম তখনো জয় দেখেছে ম্যাক্সওয়েলের ওপর ভরসা রেখে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সেই ভরসাকে সাকিব উপড়ে ফেলেছেন মধ্যাহ্নবিরতির পর প্রথম বলেই!
ম্যাক্সওয়েল আউট হওয়ার পরই ম্যাচের রাশ চলে আসে মুশফিকদের হাতে। লায়ন ও হ্যাজলউডকে তুলে নিয়ে বাকি আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরেছেন তাইজুল ও মিরাজ। কিন্তু তাঁর আগে বারবার রং পাল্টানো ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে সাকিবের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।

প্রথম দিন থেকে শুরু করা যাক। ১০ রানে নেই ৩ উইকেট! এমন পরিস্থিতিতে তামিমকে সঙ্গে নিয়ে ১৫৫ রানের জুটি গড়লেন সাকিব। লড়াইয়ের পুঁজি পেল বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া তাঁদের প্রথম ইনিংসে ২১৭ রানে গুটিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে সাকিবের ৫ উইকেট। শুধু বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে হাসেনি সাকিবের ব্যাট, সেটাও যেন দরকার ছিল তাঁর গুরুত্ব বোঝাতে। সাকিব না দাঁড়াতেই যেন দ্বিতীয় ইনিংসের রান ঠিক মনঃপূত হলো না !

কেননা, জয় ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝে যখন কাউকে দাঁড়াতে হতো, তখন কিন্তু আবারও ৫ উইকেট নিয়ে সে দায়িত্বটুকু সেরেছেন শুধু সাকিব। সেটাও ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে! আর কজন ক্রিকেটার ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টকে এভাবে রাঙাতে পেরেছে!
সাকিব রাঙাতে পেরেছেন বলেই ঢুকে পড়লেন রেকর্ড বইয়ে। টেস্ট ইতিহাসে ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ন্যূনতম হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন খুব কম ক্রিকেটার। আর সেটা একাধিকবার করে দেখাতে পেরেছেন মাত্র দুজন ক্রিকেটার—স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও সাকিব। তবে সাকিব একটি জায়গায় অনন্য—ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে ১০ উইকেট আর ন্যূনতম অর্ধশত রানের ইনিংস খেলা প্রথম ক্রিকেটার! ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে এর আগে ১০ উইকেট পেয়েছিলেন চারজন—নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি, ইংল্যান্ডের ট্রেভর বেইলি, শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরন ও ভারতের হরভজন সিং। কিন্তু এ চার ক্রিকেটারের কেউই তাঁদের ৫০তম টেস্টে ব্যাট হাতে হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি, যা পেলেন সাকিব।

তবে রেকর্ড বইকে কজন কত দিন মনে রাখে? মানুষ তো মনে রাখে, বিপদের মুখে দলের জন্য নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দেওয়ার ইতিহাসকে, প্রায় মুঠো ফসকে বেরিয়ে যাওয়া জয়কে আবারও মুঠোবন্দী করার রূপকথাকে।
মহাকাল আমাদের এভাবেই শিখিয়েছে, আর তাই আজ থেকে বহু বছর পরে যখন কোনো আড্ডায় এ ম্যাচের গল্প উঠে আসবে, তখন আমরাই বলব, ভাগ্যিস সেদিন একজন সাকিব ছিলেন !

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ