এত নৃশংসতার পরও স্বাভাবিক ছিলেন তাঁরা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী রূপা খাতুনকে ধর্ষণ শেষে ঘাড় মটকে হত্যার পরও পরিবহনশ্রমিকদের আচরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। গতকাল বুধবার সংবাদমাধ্যমে খবর পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ গ্রামের মানুষও। প্রতিবাদে টাঙ্গাইল শহরে মানববন্ধন হয়েছে। বাসের মালিক নিজেও দোষী ব্যক্তিদের বিচার চেয়েছেন।
তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় গতকাল বাসটির চালক হাবিবুর রহমান (৪৫) ও সুপারভাইজার সফর আলী (৫৫) আদালতে জবানবন্দি দেন। এর আগের দিন বাসের তিন সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯) আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তারা পাঁচজনই ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশ আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার তরুণীর মুঠোফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে।
মধুপুর থানার পরিদর্শক কাইয়ুম খান সিদ্দিকী বলেন, ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর রহমান এবং সুপারভাইজার সফর আলী ওরফে গেন্দুর জবানবন্দি গতকাল রেকর্ড করেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রুপন কুমার দাস ও হাকিম শামসুল আলম। জবানবন্দিতে তাঁরা বলেন, গত শুক্রবার বগুড়ার চারমাথা থেকে বাসটি সন্ধ্যা সাতটার পর ময়মনসিংহের উদ্দেশে যাত্রা করে। বগুড়ার বনানী এলাকা থেকে ওই তরুণীসহ আরও পাঁচ-ছয়জন যাত্রী বাসে ওঠেন। বাসটি সিরাজগঞ্জে আসার পর শুধু ওই তরুণী ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। বাস এলেঙ্গা পার হওয়ার পর চালকের সহকারী শামীম প্রথমে তরুণীকে অশোভন প্রস্তাব দেন। পরে জোর করে বাসের পেছনের আসনে নিয়ে যান। তখন তরুণী তাঁর মুঠোফোন এবং সঙ্গে থাকা পাঁচ হাজার টাকা শামীমকে দিয়ে অনুরোধ করেন, তাঁর কোনো ক্ষতি যেন না হয়। টাকা ও মুঠোফোন নেওয়ার পর শামীম তরুণীকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে বাসের অপর দুই সহকারী আকরাম ও জাহাঙ্গীরও তাঁকে ধর্ষণ করেন। বাস মধুপুর উপজেলা সদরের কাছাকাছি পৌঁছালে তরুণী চিৎকার করে ওঠেন। এ সময় শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর তাঁর ঘাড় মটকে হত্যা করেন। পরে মধুপুর শহর পার হয়ে বনাঞ্চলে প্রবেশের পর পঁচিশ মাইল এলাকার সুমি নার্সারির কাছে তরুণীর মরদেহ ফেলে দেন।
মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নিহত তরুণীর মুঠোফোনটি মধুপুর থানা-পুলিশ ময়মনসিংহের মির্জাপুর গ্রামের শামীমের বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া তরুণীর ভ্যানিটি ব্যাগটি মধুপুর বনাঞ্চলের টেলকির কাছাকাছি জায়গায় পাওয়া গেছে।
আসামিদের গ্রামেও ক্ষোভ
গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে হাবিব, সফর আলী, আকরাম ও জাহাঙ্গীরের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। আর শামীমের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার নন্দীপুর গ্রামে।
গতকাল দুপুরে মির্জাপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় গ্রামবাসী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। পরিবারের সদস্যরা বলেন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তাঁরা সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছেন। ওই ঘটনার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাড়িতে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করেন।
চালক হাবিবের মা জাহানারা বেগম বলেন, ২০ বছর আগে দুই ছেলে আর এক মেয়েকে রেখে স্বামী মারা যান। খুব কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই সন্তান আজ আমারে লজ্জায় ডুবাইল। বিশ্বাস করতে কষ্ট অইতাছে, আমার ছেলে এমন কাম করতে পারে।’
জাহাঙ্গীরের মায়ের নামও জাহানারা। বাড়িতে যাওয়ার পর তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘যদি আমার পোলা এই কাম কইর্যা থাকে, তাহলে আমার কোনো কিছু বলার নাই।’
আকরাম ও সফর আলী সম্পর্কে মামা-ভাগনে। লজ্জায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি পরিবারের সদস্যরা। জানালেন, এই দুজন জড়িত থাকলে যেন তাঁদের বিচার হয়।
মির্জাপুর গ্রামের মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা। এই ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে তাঁরা বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এক পরিবহনশ্রমিক বলেন, যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশের সব পরিবহনশ্রমিকের মাথা নিচু করেছেন। তাঁদের ফাঁসি হওয়া উচিত।
ময়মনসিংহ-বগুড়া পথে চলাচলকারী ছোঁয়া পরিবহনের যে বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই বাসের মালিক আমেনা খাতুন। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। আমেনা খাতুনের স্বামী মো. খোকন চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করতেন। আমেনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন নারী হিসেবে আমি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
লাশ তোলার আবেদন
তরুণীর লাশ শুক্রবার রাতে উদ্ধার হওয়ার পর শনিবার টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে ওই দিনই টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাঁকে দাফন করা হয়। এখন লাশ তুলে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবার। নিহত তরুণীর বড় ভাই হাফিজুল ইসলাম প্রামাণিক লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের কাছে আবেদন করেছেন।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. মাহবুব আলম গতকাল বিকেলে তাঁর সভাকক্ষে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।