গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের আহাজারি

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গত মাসের শেষের দিকের এক বিকেলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সরাফউদ্দিনবিল গ্রামটি ঘিরে ফেলেন সেনাসদস্যরা। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ শুরু করেন। দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করলে সেনাসদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালান। এ সময় বুক ও ডান হাতে গুলি লাগে হোসেন জোহার (২২)। অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। জ্ঞান ফিরে দেখেন মা, বাবা ও চার ভাইবোনের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে তাঁর পাশে। এরপর তিনি এক প্রতিবেশীর সঙ্গে গত ৩০ আগস্ট বাংলাদেশের টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গাশিবিরে আশ্রয় নেন। অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে আজ রোববার তাঁকে পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

চট্টগ্রামে পাঠানোর আগে সদর হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের জীবনের দুঃসহ ঘটনার এমন বিবরণ দেন হোসেন জোহা। শুধু তিনি নন, গত ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২০টির বেশি সীমান্তচৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযানের নামে দমনপীড়নে গুলিবিদ্ধ অন্তত ৬৪ জন রোহিঙ্গা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এখন পর্যন্ত ৩২ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। এর মধ্যে দুজন মারা গেছেন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৩০ জন।

এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন গুলিবিদ্ধ ১৫ জন রোহিঙ্গা। আর এখানে ভর্তি আছেন ১৫ জন। এ ছাড়া কক্সবাজার ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি আছেন গুলিবিদ্ধ ২ জন রোহিঙ্গা।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের পঞ্চম তলার পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডের ৪৭ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন হোসেন জোহা। নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কাঁদছিলেন তিনি। গুলি লাগার ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শরীর আর মনের যন্ত্রণায় কাঁতর জোহার আহাজারি বিষণ্ন করে তুলছিল হাসপাতালের পরিবেশ।

হোসেন জোহার সঙ্গে একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন মংডু শহরের তুলাতলী গ্রামের মো. আয়াছ (১৮)। তাঁর ভাষ্য, গত ২৯ আগস্ট তাঁর বাড়িতে গুলি চালান সেনাসদস্যরা। তাঁর চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তাঁর মা ও বড় ভাই। এ সময় তাঁর বাম হাতেও গুলি লাগে। তিনি দৌড়ে পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন। জঙ্গলে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে তাঁর শরীর ঝলসে যায়। এর পরের দিন চাচাতো ভাই ছৈয়দুল আমিনের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এরপর তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। আজ সকালে হোসেন জোহার সঙ্গে তাঁকেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।

আরেক গুলিবিদ্ধ রাখাইন রাজ্যের কোয়ানচিবং গ্রামের মোহাম্মদ হোবাইবের (২৫) বাবা আক্তার হোসেনের ভাষ্য, গত ৩০ আগস্ট সকালে সেনাসদস্যরা তাঁদের গ্রামে হামলা চালান। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। যুবকদের ধরে নিয়ে যান। অনেককে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। তাঁর ছেলে হোবাইবকে বাড়ি থেকে বের করে উঠোনে দাঁড় করিয়ে গুলি করেন। এতে বুক ও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয় ছেলে। তার অবস্থা খারাপ।

গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার বিষয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শাহিন আবদুর রহমান বলেন, ‘তাদের রোহিঙ্গা নয়, রোগী হিসেবে বিবেচনা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখানে যাঁরা চিকিৎসা নিতে এসেছেন, তাঁরা সবাই গুলিবিদ্ধ।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ