পাহাড়-জঙ্গলে লতাপাতা খেয়ে বেঁচে ছিলেন তাঁরা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: দিল বাহারের বয়স ৬০। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানে প্রাণ গেছে তাঁর ছেলে মাহবুবের। ঘরবাড়ি ছারখার হয়েছে। নাতি আর স্বামীকে নিয়ে পালিয়ে ১২ দিন কাটিয়েছেন পাহাড়-জঙ্গলে। সঙ্গে থাকা চাল শেষ হয়ে গেছে আট দিনেই। বাকি দিনগুলো কাটিয়েছেন বৃষ্টির পানি আর লতাপাতা খেয়ে।
এরপর মাছ ধরার কাঠের নৌকায় চেপে এসে নেমেছেন বাংলাদেশ সীমান্তের উপকূলে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বিবিসির সাংবাদিক সঞ্জয় মজুমদারের সঙ্গে।
সঞ্জয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল বাহার একটানা কাঁদছিলেন। তাঁর স্বামী জাকির মামুন পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখে দাঁড়ি। দুর্বল শরীর। সঙ্গে রয়েছে নাতি মাহবুব। কিশোর মাহবুবের হাত ব্যান্ডেজের মতো করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার মুখ। দিল বাহার জানালেন, মাহবুবের হাতে গুলি লেগেছে।
জাকির মামুন জানালেন, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের বুথিডং এলাকায় তাঁদের বাড়ি। হঠাৎই হামলা চলে তাঁদের গ্রামে। জাকির বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িসহ অনেক বাড়িতে বোমা ছোড়ে। আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামবাসী পালানোর চেষ্টা করলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সারা রাত ধরে গুলি চলেছে। পরদিন সকালে দেখি গ্রামটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গ্রামের বাড়িগুলো থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সবকিছু হারিয়েছি আমরা। হামলায় মারা গেছেন আমার ছেলে—মাহবুবের বাবা। পরে আমরা প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ি।’
জাকির-দিল বাহারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রাণভয়ে বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে কয়েকটি বাসনপত্র ও চাল নিয়ে বের হন তাঁরা। ১২ দিন ধরে তাঁরা দুটি পাহাড় ও বনজঙ্গলে ঘুরেছেন। তাঁদের কাছে যেটুকু চাল ছিল, তা আট দিনেই শেষ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে লতাপাতা ও বৃষ্টির পানি খেয়ে প্রাণ বাঁচান তাঁরা। বাংলাদেশ সীমান্তের উপকূলে নামার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মাহবুবকে।
ছোট ছোট নৌকায় চেপে বাংলাদেশ উপকূলে ভিড়ছে রোহিঙ্গারা। কাছাকাছি গেলে দেখা যাবে গাদাগাদি করে আছে রোহিঙ্গারা। নৌকার পাটাতনে রয়েছেন নারীরা। শক্ত করে ধরে রেখেছেন শিশুদের। পুরুষেরা নৌকার একদিকে বসে রয়েছেন। সীমান্তের শ্যামলাপুরের কাছেই আরেকটি নৌকা ভিড়ল। তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কালো পোশাক পরা মধ্যবয়সী এক নারীকে। নাম রহিমা খাতুন। উদ্বিগ্ন চোখে তাকাচ্ছিলেন এদিক-সেদিক।
রহিমা খাতুন তাঁর ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জানালেন, ১০ দিন আগে মিয়ানমারের মংগদুতে তাঁদের এলাকায় হামলা হয়। পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে অনেকেই আলাদা হয়ে যায় একে অন্যের থেকে। তখন থেকেই প্রতিদিন তীরে এসে ভাই নবি হাসানকে খোঁজেন রহিমা। ৪ নম্বর নৌকাটি তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ছুটে গেলেন রহিমা। তাঁর দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল এক যুবককে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন তাঁরা। বোঝা গেল তিনিই রহিমার সেই হারিয়ে যাওয়া ভাই।
রহিমা ও নাবি ভাবেননি আবার দেখা হবে। নাবি বললেন, ‘পরিবারের ১০ সদস্যের মধ্যে বেঁচে আছি মাত্র দুজন। গ্রামে হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী।’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ ধরনের হামলার কথা অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য, তারা কেবল রোহিঙ্গা জঙ্গিদের লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে। রাখাইনে পুলিশ চৌকিতে হামলাকারীদের লক্ষ্য করেই তাঁদের অভিযান।
কক্সবাজারে বালুখালীর একটি শরণার্থীশিবিরে আছেন অনেক রোহিঙ্গা। অনিশ্চিত জীবনের দুশ্চিন্তায় থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য এটি একটি অস্থায়ী আবাস। সাধারণ প্লাস্টিক ও বাঁশ দিয়ে এই শিবির তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
জাকির মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশে পৌঁছে তিনি একটু স্বস্তি পাচ্ছেন। এটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে তাঁরা নিরাপদে থাকবেন।’