অং সান সু চিকে ডেসমন্ড টুটুর চিঠি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী ধর্মযাজক ও মানবতার পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠ ডেসমন্ড টুটু দীর্ঘদিন পর নীরবতা ভাঙলেন। তাও নিজ দেশের মানুষের জন্য নয়; দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বহু দূরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে লেখা চিঠিতে ৮৫ বছর বয়সী ডেসমন্ড টুটু লিখেছেন, ‘বোন, তোমার নীরবতার কারণ যদি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার বিনিময়ে হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এর মূল্য বেশ চড়া। যে দেশের নেতৃত্ব এক ন্যায়পরায়ণতার প্রতীকের হাতে, তার জন্য এটি বেমানান। তুমি যদি অটুট নীরবতায়ই নিজেকে অটল রেখে থাকো, তাহলে আমি বলব, এ নীরবতার দাম তোমার দেশের অসহায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দিতে হচ্ছে অনেক অশ্রু আর রক্তের মধ্য দিয়ে।’
১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই ধর্মযাজক লিখেছেন, ‘বার্ধক্য আমাকে গ্রাস করেছে, আমি এখন জ্বরাগ্রস্ত, সবকিছু থেকে অবসর নিয়েছি। ঠিক করেছিলাম সর্বজনীন বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আর কিছু বলব না। কিন্তু আজ তোমার দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের গভীর সংকটে সেই নীরবতা আমি ভাঙছি।’
ডেসমন্ড টুটু অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় লিখেছেন, ‘বহু বছর ধরে আমার টেবিলে একটি ছবি ছিল। মিয়ানমারের জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য তোমার ওপর অবিচার ও আত্মত্যাগের কথা, সেটি আমাকে মনে করিয়ে দিত। তুমি ছিলে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক।’ তাঁর শেষ আরজি, ‘আমরা প্রার্থনা করি, তুমি ন্যায়বিচারের পক্ষে মুখ খোলো, মানবতার পক্ষে কথা বলো, দেশের মানুষের ঐক্যের কথা বলো।’
কেবল জেসমন্ড টুটু নন, আরও অনেক নোবেল বিজয়ী মিয়ানমারের চলমান গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন। এমনকি সু চির একজন জীবনী লেখকও তাঁর নীরবতায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ডেসমন্ড টুটুর চিঠিটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ঘটনায় ফরাসি দার্শনিক আদ্রেঁ মালরোর সেই অবিস্মরণীয় বিবৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই বিবৃতিতে ফরাসি সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আদ্রেঁ মালরো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নিজেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭০ বছর। শেষ পর্যন্ত মারলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও তাঁর সেই আহ্বান বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘অং সান সু চি কখন এই জাতিগত নিপীড়নের নিন্দা জানাবেন, আমি তার অপেক্ষায় আছি।’
আরও অনেক নোবেল বিজয়ী, অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁরা সু চিকে নীরবতা ভেঙে বিপন্ন ও আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন। কিন্তু এসব আহ্বান ও আকুতি মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রীর চৈতন্য জাগাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে নীরবতা ভেঙে চলেছে, কখন সু চি তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটছে না। কয়েক মাস আগে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, জাতিগত নির্মূল শব্দটি ব্যবহার করা খুবই কঠিন ও অন্যায়। কিন্তু মিয়ানমারে যা ঘটছে, তা মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী। সেখানে প্রতিনিয়ত মানবতা লাঞ্ছিত হচ্ছে।
নিচের উদাহরণ থেকে সেখানকার মানবিক বিপর্যয় ও উৎপীড়নের ভয়াবহতা আঁচ করা যাবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়নের মুখে তাঁদের মধ্য থেকে এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং তারা নয় মাসের ব্যবধানে স্বদেশে ফিরে আসতে পেরেছিল। অন্যদিকে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা লোকসংখ্যা ১৪ লাখের বেশি হবে না। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছে ৪ লাখের মতো। গত অক্টোবরে এসেছে আরও ৮০ হাজার। জাতিসংঘের হিসাবমতে, এবারে তিন লাখের ওপরে। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অর্ধেক কিংবা তার বেশি বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তানে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।
সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ‘বানের পানির লাহান’ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকছে। আর এই সেই জনস্রোত থামাতে মিয়ানমার সরকার সীমান্তে মাইন পুতে রেখেছে, মাইনের আঘাতে অনেকে মারা গেছে, অনেক হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এরপরও যদি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি বলেন, রাখাইন রাজ্যে সবকিছু ঠিক আছে, কোনো সহিংসতা হচ্ছে না, এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে?
যে অং সান সু চি গণতন্ত্রের আন্দোলন করতে গিয়ে বহু বছর জেল খেটেছেন, অন্তরীণ থেকেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, সেই অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয় বা ট্র্যাজেডিতে নীরব থাকবেন, সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইবেন, এটি কোনোভাবে মানা যায় না। তাহলে মিয়ানমারে অত্যাচারী সামরিক শাসকদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য থাকল কোথায়?
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার পর অং সান সু চিই সর্বাধিক বছর জেল খেটেছেন বা গৃহবন্দী ছিলেন। গণতন্ত্র ও অহিংসার আন্দোলন করার জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সেই অং সান সুচির সরকার অহিংসার বিরুদ্ধে হিংসা ছড়িয়ে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে!
ডেসমন্ড টুটু সু চিকে নীরবতা ভাঙতে বলেছেন। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, তিনি নীরব নন। বরং সব ধরনের মানবিক অধিকারবঞ্চিত একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরবে ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছেন।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে, স্টেট কাউন্সিলর হয়ে তিনি যে কারাগারে বন্দী হয়েছেন, তার নাম সংখ্যাগুরু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী উগ্রপন্থা ও হিংসার কারাগার। সামরিক শাসকের জাতিবৈরী আইনের লৌহ কপাট।