রশিদের ঢাল হানিফ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: চালের বাজার এখন লাগামহীন। দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। সরকারের দুই মন্ত্রীর অভিযোগ, মুনাফা লুটতে চালকলমালিকেরা পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর এই কারসাজির মূলে আছেন দেশের বৃহত্তম চালকল কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টের মালিক আবদুর রশিদ। তাঁর গুদামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযানও চালিয়েছে।
কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবদুর রশিদ এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোক। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের হাত ধরে তিনি ও তাঁর ভাই বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এখন হানিফের পেছনে পেছনেই হাঁটছেন তিনি।
দলীয় কোনো পদে না থাকলেও আবদুর রশিদ এত দিন বিএনপি সমর্থক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ভাই সিদ্দিকুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, এখন সদর উপজেলার আইলচারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আর সে কারণে চালের বাজারের অন্যতম এই নিয়ন্ত্রকের হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া নিয়ে কুষ্টিয়ার নেতা-কর্মীদের মনে সন্দেহ। সেই সঙ্গে চালের দামের লাগাতার বৃদ্ধি সে সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে আবদুর রশিদ বলেন, ‘হানিফ সাহেবের হৃদ্যতা আকর্ষণীয়। যে সাধারণ মানুষের পেছনে থাকবে, আমরা তার পেছনে আছি। তবে আমি ব্যবসা করি, রাজনীতি নয়। বিএনপিরও কোনো পদে আমি ছিলাম না। আওয়ামী লীগেও না।’
জানতে চাইলে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, তিনি ও তাঁর ভাই দলে যোগ দিয়েছেন, সেটা ঠিক। তবে এ জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা তিনি পাননি। তাঁর গুদামেও অভিযান হয়েছে।
চালের দাম দফায় দফায় বাড়তে থাকায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেন, চাল নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দামে কারসাজি করছেন। এর আগে সোমবার কুষ্টিয়ায় আবদুর রশিদের মিলে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে জেলা প্রশাসন। এরপর শনিবার নাটোরে রশিদের মিলে আবার অভিযান হয়, আবারও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত রোববার তাঁর কুষ্টিয়ার মিলে তদারকিমূলক অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে আজ খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সে বৈঠকে আবদুর রশিদকেও থাকতে বলা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ঈদুল আজহার পর কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে কমপক্ষে ৮ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে যে মিনিকেট চাল আসে, তার বড় অংশ যায় কুষ্টিয়ার ৩১টি স্বয়ংক্রিয় বা অটো রাইস মিল থেকে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় চালকলটির মালিক ওই আবদুর রশিদ। কুষ্টিয়া ও নাটোরে আবদুর রশিদের ৪টি অটো রাইস মিল আছে। এর পাশাপাশি আছে ১৫টি গুদাম। গুদামগুলোর ধারণক্ষমতা ৩ লাখ ৫৮ হাজার বস্তা (প্রতি বস্তায় ৬৫ কেজি), যা প্রায় ২৫ হাজার টনের সমান।
অবশ্য দুই দফা অভিযানের পরও আবদুর রশিদের মিলে অবৈধ মজুতের প্রমাণ পায়নি জেলা প্রশাসন। চালের বস্তায় উৎপাদনের তারিখ লেখা না থাকায় তাঁকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
গুদামে বাড়তি মজুতের অভিযোগ সম্পর্কে আবদুর রশিদ বলেন, ‘গুদামে অস্বাভাবিক মজুত থাকলে রশিদের গায়ে জামা থাকত না।’
এদিকে খাজানগর মোকামে চালের বাজার গতকাল সোমবার স্থিতিশীল ছিল। চালের কেনাবেচাও কিছুটা কম হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, আড়তদারদের কাছে প্রচুর চাল আছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, মিলমালিকদের মতো তাঁদের গুদামেও অভিযান হবে। এ কারণে তাঁরা চাল কম ঢুকিয়ে গুদাম খালি করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।
দেশজুড়ে বিভিন্ন মিলে অভিযানের কারণে কুষ্টিয়ার চালকলমালিকেরাও আতঙ্কিত। রোববার রাতে কুষ্টিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে যে আবদুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হবে। এতে চালকল মালিক সমিতির স্থানীয় নেতাদের সবাই তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ রাখেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে চালকল মালিক সমিতির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, ফোন বন্ধ রাখার মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
এদিকে গতকাল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার অন্যতম বড় চালকল বিশ্বাস অ্যাগ্রো ফুডে তদারকিমূলক অভিযান চালায় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। এ অভিযানে অবৈধ কোনো মজুত পাওয়া যায়নি বলে জানান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান।
অভিযানে দুজন আটক, পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
অবৈধ চালের মজুত খুঁজতে গতকাল দেশের চারটি জেলায় অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে দুজন ব্যবসায়ীকে আটক ও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট।
বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত রাজশাহী নগরের বিসিক এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেন। এতে নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সুব্রত পাল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ছিলেন রহিমা সুলতানা ও উম্মে তাবাসসুম।
আদালত হামিম অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ২৯ বস্তা চাল পান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির চাল মজুতের কোনো লাইসেন্স নেই। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ফয়সাল হোসেনকে আটক করা হয়।
আদালত একই এলাকার আসলাম রাইস মিলসে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ২৮৫ বস্তা ধান এবং ১০০ বস্তা চাল পান। এই প্রতিষ্ঠানের ধান-চাল মজুত করার লাইসেন্স নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আবার নামে ‘রাইস মিল’ হলেও এখানে কোনো মিল নেই। শুধু গুদামে বড় বস্তা ভেঙে নিজেদের ব্র্যান্ডের ছোট বস্তায় ভরা হয়। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আসলাম তোহাকে আটক করা হয়েছে।
এডিএম সুব্রত পাল গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় বলেন, হামিম অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেড ও আসলাম রাইস মিলস অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত করেছে। তাই এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এ সময় নাটোর র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার শেখ আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অংশ নেয়। বাজারের সততা ট্রেডার্সের মালিক রায়হান উদ্দিনকে ৭০ হাজার টাকা, চৌধুরী ট্রেডার্সের মালিক কিশোর কুমার চৌধুরীকে ৫০ হাজার টাকা, জাহাঙ্গীর আলমকে ৫০ হাজার এবং কে এম ট্রেডার্সের মালিক আলমগীর কবিরকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালতের নির্বাহী হাকিম মোর্তুজা খান। এসব চালকলমালিকের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে চাল মজুত, ওজনে কম দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রতিটি চালকলে বিশেষ অভিযান চলছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সাড়ে সাতরশি বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোকসানা রহমান। আদালত বাজারের চাল ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন খানের (৫০) গুদামে অতিরিক্ত চালের মজুত পান। আবার এই গুদামমালিকের কোনো লাইসেন্স নেই। এ ঘটনায় তোফাজ্জলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
রোকসানা রহমান বলেন, লাইসেন্স না থাকলে কেউ গুদামে সর্বোচ্চ ১ মেট্রিক টন চাল মজুত করতে পারেন। কিন্তু ওই গুদামে ২৭৮ মেট্রিক টন চাল পাওয়া গেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬ অনুযায়ী গুদামের মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।