আ.লীগ নেতার ময়লা–চাতুর্য

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বছর তিনেক আগেও ছিল বিশাল পুকুর। আয়তন প্রায় তিন বিঘা বা এক একর। হঠাৎ পুকুরটিতে একটু একটু করে ময়লা-আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। একসময় গতি বাড়ে ময়লা ফেলায়। ফলে দুই-আড়াই বছরে পুকুরটি প্রায় ভরাট হয়ে ওঠে। এখন ওপরে বালু ফেলে জায়গাটি ব্যবহারের উপযোগী করার প্রক্রিয়া চলছে। দলীয় লোকজন নিয়ে এ কাজ করছেন রাজধানীর দক্ষিণখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
পুকুরের মালিক রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দুই বছর আগে বলেছিল, তারা এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে। দুই বছর পর এবার তারা বলল, পুকুরটি যে দখল হয়ে গেছে, সে খবরটি তারা জানতে পারেনি।
উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টর আর দক্ষিণখান ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। জায়গাটি দক্ষিণখান ইউনিয়নের কোটবাড়ী এলাকা নামে পরিচিত। কোটবাড়ী রেললাইনের পাশেই এই আলোচিত পুকুর।

সরেজমিনে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা ফেলে পুকুরটি প্রায় ভরাট করে ফেলা হয়েছে। চারদিকে সমান উচ্চতায় ময়লা ফেলা হয়েছে। এক পাশ খানিক নিচু আছে। এখন বর্জ্য সংগ্রহকারীরা ভ্যানগাড়িতে আনা ময়লা সেই নিচু অংশে ফেলে সমান করছে।
গত বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখা যায়, অন্তত ২৫টি ময়লার গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়ানো। একের পর এক ময়লা নিয়ে ভ্যানগাড়ি আসছে। কয়েকজন মিলে ভ্যানগাড়ির পুরো ময়লা উপুড় করে নিচু অংশে ঢেলে দিচ্ছেন। আর একজন আঁচড়া দিয়ে সেগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
অন্তত ১০ জন বর্জ্য সংগ্রহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় আড়াই বছর ধরে তাঁরা পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। তাঁদের দাবি, ‘মালিকপক্ষ’ তাঁর পুকুরটি ভরাট করার নির্দেশ দিয়েছে। তাঁর হিসাবে প্রতিদিন এক-দেড় শ গাড়ি ময়লা এই পুকুরে ফেলা হয়।
রেললাইনের উত্তরা অংশে পুকুর থেকে স্বল্প দূরত্বে সাপ্পোরো ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড মেডিকেল হাসপাতাল, ডেলটা হাসপাতাল ও আইচি হাসপাতাল। অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের কাজ চলছে হাসপাতালগুলোর বিপরীতেই। ফলে দুর্গন্ধে হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক ও এলাকাবাসীর ভোগান্তি উঠেছে চরমে।
আইচি হাসপাতাল লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বাতাসের সঙ্গে ময়লার দুর্গন্ধ আসে। রোগীরা হাসপাতালে থাকতে পারছে না। দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম তোফাজ্জল হোসেনকে ময়লা ফেলা বন্ধের জন্য একাধিকবার লিখিত অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এলাকার ময়লা সংগ্রহকারীরা জানান, শাওন আহম্মেদের মালিকানায় থাকা ভ্যানগাড়িগুলো এলাকা থেকে ময়লা সংগ্রহ করে এখানে এনে ফেলে। শাওন আহম্মেদ দক্ষিণখান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শামীম আহম্মেদের (বাপ্পী) ছোট ভাই। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের কর্মী। জানতে চাইলে শাওন আহম্মেদ বলেন, ময়লা ফেলার জায়গা ছিল না, তাই এখানে ফেলা হচ্ছে। পুকুর দখলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ছোট মানুষ। এসব বিষয়ে দক্ষিণখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন।’
মেসার্স নাজমুল এন্টারপ্রাইজের নাম লেখা কয়েকটি ভ্যানগাড়িতে করেও ময়লা ফেলা হচ্ছিল পুকুরে। নাজমুল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. লিটন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি দল করি। বড় কোনো পদে নাই। দক্ষিণখান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে আছি।’ তিনি বলেন, ‘পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এখন বালু ফেলে যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে। চাইলে তাঁরা অস্থায়ী দোকানও করতে পারবে।’ কারা দোকান করতে পারবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে সব ব্যবস্থা করছে।’
পুকুরে ময়লা ফেলার কাজে নিয়োজিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুকুর ভরাটের কাজ তদারকের দায়িত্বে আছেন দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের ঘনিষ্ঠ মো. হানিফ। তিনি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত। মো. হানিফ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের কর্মী। একসময় ছাত্রলীগ, যুবলীগ করতাম। এখন চেয়ারম্যানের সঙ্গে আছি।’
পুকুর ভরাটের বিষয়ে মো. হানিফ বলেন, ‘রেলের পুকুরের বিষয়ে রেলওয়ে ভালো বলতে পারবে। ভরাটের পরে কী হবে, তা বড় নেতা আর প্রশাসন বলতে পারবে। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’ মো. হানিফের ছেলে সিফাত আহম্মেদ দক্ষিণখান থানা ছাত্রলীগের নেতা। পুরো এলাকা বিশেষ করে যেখানে পুকুর ভরাট হচ্ছে, তার আশপাশে সিফাত আহম্মেদের নামে ব্যানার, পোস্টার দেখা যায়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় আড়াই বছর আগে পুকুরটি ভরাট করা শুরু হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তোফাজ্জল হোসেন দখলের উদ্দেশ্যে ময়লা ফেলে পুকুরটি ভরাট করছেন। অবশ্য এ বিষয়ে ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ময়লা ফেলে ভরাট হচ্ছে রেলের পুকুর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে সে সময় দক্ষিণখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন পুকুর দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছিলেন, রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই পুকুরে ময়লা ফেলা হচ্ছে। আবার তিনি এও বলেছিলেন, ১৫-২০ দিনের মধ্যে পুকুরে ময়লা ফেলা বন্ধ করা হবে।
তোফাজ্জল হোসেন উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদকও। যোগাযোগ করা হলে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘রেলের জায়গা কি চাইলেই কেউ দখল করতে পারে? আমি রেলের জায়গা দখল করতে যাব কেন?’ তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নটি সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত হওয়ার পর থেকে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে এসটিএসে (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন) ময়লা ফেলার অনুমতি নিয়েছি। এরপর থেকে ময়লা সংগ্রহকারীদের সেখানেই ময়লা ফেলার নির্দেশ দেওয়া আছে। পুকুরে ময়লা ফেলতে মানা করার পরেও তারা শুনছে না।’
রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (পূর্ব) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘রেলের পুকুর ভরাটের অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। এভাবে যে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে, বিষয়টি জানা ছিল না। ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়ে বিষয়টি দেখা হবে।’
২০১৫ সালে পুকুর ভরাটের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি জাতীয় দৈনিক যখন প্রতিবেদন করেছিল, তখন রেলের ঢাকা বিভাগের কর্মকর্তা বলেছিলেন, ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন চেয়ারম্যান কীভাবে রেলের পুকুর ভরাট করছেন, সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুই বছরের মাথায় এসে এখন তিন বিঘার পুকুরটি ময়লার নিচে হারিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, শহরের বিভিন্ন এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার একটি বড় কারণ শহর থেকে একের পর এক পুকুর ভরাট করা।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ