সোনারগাঁও হোটেল ও ফার্মগেট মোড়ের টানা গেট অচল
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে ২৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ব্যয়ে তিনটি মুভিং মিডিয়ান (রাস্তার মাঝখানে টানা গেট) তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এক মাসও এগুলো ব্যবহার করা যায়নি। এখন কার্যত এগুলো পরিত্যক্ত হয়ে আছে।
তিনটি টানা গেটের দুটি সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে সার্ক ফোয়ারার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে। বাকিটি ফার্মগেট পুলিশ বক্সের সামনে। এগুলো তৈরির উদ্দেশ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচলের সময় ব্যস্ত মোড়গুলোয় ডাইভারসনের (বিকল্প পথে চলাচল) ব্যবস্থা করা। বাস্তবে জনচলাচল নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কারণ, ঢাকার রাস্তায় ভিআইপি চলাচলের সময় সব যান চলাচল একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পথচারীদেরও হাঁটতে দেওয়া হয় না। ফলে ব্যস্ত এই দুই মোড়ে ফাঁকফোকর গলে যেন কেউ পারাপার হতে না পারে তাই এই উদ্যোগ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) জামান এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো নির্মাণ করায়।
এর আগে উল্টোপথে যানবাহন চলাচল ঠেকাতে ২০১৪ সালে হেয়ার রোডে কাঁটাযুক্ত বিশেষ এক প্রতিরোধক যন্ত্র বসিয়েছিল পুলিশ। ১২ দিনের মাথায় ৫ লাখ টাকার এই যন্ত্র অচল হয়ে যায়। এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরের একটু সামনে শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সড়কে আরেকটি প্রতিবন্ধক বসানো হয়। সেটা বেশ কিছুদিন সচল ছিল।
মুভিং মিডিয়ান বা টানা গেটের ব্যবহারকারী পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যথাযথ নকশা না করা ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় মিডিয়ানগুলো কাজ করছে না।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, মুভিং মিডিয়ান তিনটি নির্মাণে দরপত্র আহ্বান ও কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোল্লাহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। ২০১৪ সালে দরপত্রে ঘষামাজা ও জালিয়াতির অভিযোগে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। মুভিং মিডিয়ানগুলো সম্পর্কে তথ্য চাইলে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে লিখিত আবেদন করতে বলেন। লিখিত আবেদনের ২০ দিন পর এ-সংক্রান্ত অসম্পূর্ণ কিছু তথ্য সরবরাহ করা হয়।ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা জানতে চাওয়া হলেও শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘এগুলো যেমন মসৃণ হওয়ার কথা ছিল, তেমন হয়নি। নষ্ট হয়ে গেছে। বিষয়টি ডিএনসিসিকে জানানো হয়েছে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, সার্ক ফোয়ারার উত্তর ও দক্ষিণ পাশের দুটি মুভিং মিডিয়ান একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে। এগুলোকে কেচিগেটের মতো টেনে রাস্তার এ পাশ থেকে ও পাশে নেওয়ার জন্য সড়কে বসানো হয়েছিল স্টিলের পাত। সে পাতগুলো ভেঙে গেছে। এর ওপর দিয়ে গাড়ি গেলে খটাস খটাস শব্দ হয়। কয়েকটি নাটবল্টুও খোলা।
এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য মো. নাছির উদ্দিন বলেন, সাধারণত কাঠের পাটাতন দিয়ে ডাইভারশনের কাজ করা হয়। কিন্তু এতে ফাঁকফোকর থাকে। এই ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষ ও অনেক সময় মোটরসাইকেল এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে যায়। এতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু মুভিং মিডিয়ান পার হয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সোনারগাঁও হোটেলের দুই অটোগেট নির্মাণের পর ১৫-২০ দিন কাজ করেছে। এরপর থেকেই নষ্ট হয় পড়ে আছে।
ফার্মগেট পুলিশ বক্সের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের উত্তর পাশে মুভিং মিডিয়ানটি জড়ো করে রাখা। এর সামনে সিমেন্টের তৈরি স্ল্যাব ফেলে রাখা হয়েছে। মিডিয়ানের নিচে জমে আছে আবর্জনা। দেখেই বোঝা যায়, এর ব্যবহার নেই। সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের দুজন সদস্য জানিয়েছেন, এটি তাঁরা কখনো ব্যবহার করতে দেখেননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আবিদুল ইসলাম বলেন, প্রথমে সার্ক ফোয়ারার দুটি ও পরে ফার্মগেটেরটি নির্মাণ করা হয়। সার্ক ফোয়ারার দুটি নির্মাণ করার পর সমস্যা দেখা দিলে ফার্মগেটেরটির নকশায় পরিবর্তন আনতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তা করেনি। তারা ফার্মগেটের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যায়। তিনি বলেন, এগুলো এত চওড়া যে টেনে রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে নিতে চার-পাঁচজন লোক লাগে। তাই এগুলো আর ব্যবহার করা যায় না। আগের মতো ট্রাফিক পুলিশের ব্যবহৃত সড়ক প্রতিবন্ধকতা সরঞ্জাম দিয়েই এখন কাজ করা হয়।
ডিএনসিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মিডিয়ান তিনটি নির্মাণ করা হয়। প্রতিটিতে গড়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
জানতে চাইলে মোল্লাহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স ও ঠিকাদারের ১০ শতাংশ লাভ অন্তর্ভুক্ত থাকায় নির্মাণ ব্যয় কিছুটা বেশি হয়েছে। নুরুজ্জামানের দাবি, মিডিয়ানগুলো এখনো সচল আছে। নষ্ট হওয়ার তথ্য তাঁর কাছে নেই।
২০১৪ সালে তাঁকে বরখাস্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, দরপত্র সংক্রান্ত একটি বিষয়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে জালিয়াতি বা ঘষামাজার অভিযোগ ছিল না। তাহলে কী অভিযোগ ছিল আপনার বিরুদ্ধে-এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সাক্ষাতে বিস্তারিত বলব।’
এ মিডিয়ানের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে একটি তৈরি করে ব্যবহারকারীর পর্যবেক্ষণ ও কার্যকারিতা বিবেচনা করে বাকি দুটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। এতে জনগণের টাকার অপচয় হতো না। তিনি বলেন, মিডিয়ান তিনটি তৈরির ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি মনে হচ্ছে। দরপত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, প্রয়োজনে তা তদন্ত করা উচিত।