স্থলমাইনের ফাঁদে রোহিঙ্গারা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নাইক্ষ্যংছড়ি সদর উপজেলা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের পাহাড় বড় শণখোলা। দুর্গম এই পাহাড়ি পথের অর্ধেকই পায়ে হাঁটা। সেই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে সাত হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। নামমাত্র যে ত্রাণ সেখানে যাচ্ছে, তা নিতে হচ্ছে মানুষের মাথায় করে।
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্যরেখা ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই ত্রাণশিবিরের ওপারে মিয়ানমারের মংডু জেলার পালঙ্গাঝিরি গ্রাম। গতকাল শুক্রবার সেই ত্রাণশিবিরে গিয়ে শোনা গেল বিস্ফোরক তথ্য। ত্রাণশিবিরের রোহিঙ্গারা জানালেন, শূন্যরেখা ঘেঁষে প্রায় ৭০ কিলোমিটার সীমান্তে হাজার হাজার স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা এখন আর আসা-যাওয়া করতে পারছে না।
স্থলমাইন বিস্ফোরণে গত এক মাসে ১০ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছেন। হতাহত ব্যক্তিদের দুজন বাংলাদেশি, বাকিরা রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তে স্থলমাইন পোঁতা নিষিদ্ধ। তারপরও মিয়ানমার তা লঙ্ঘন করে স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। তবে প্রথম দিকে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা এসব স্থলমাইনকে ইমপ্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বলে জানালেও এখন তাঁরা মাইন বলেই উল্লেখ করছেন।
দুনিয়াজুড়ে মাইন নিষিদ্ধ হলেও মিয়ানমার ‘স্থলমাইন নিষিদ্ধকরণ’-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে সই করেনি। এর আগেও মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু স্থানে স্থলমাইন পুঁতে রেখেছিল। তবে এর পরিমাণ ছিল কম। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর সেটা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গারা এখন যে বিপদে আছে, সীমান্তের স্থলমাইন তাদের সেই বিপদকে আরও এগিয়ে দিয়েছে। সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক মহলকে এটা জানানো যে, সীমান্তে এ ধরনের অপরাধ করেই যাচ্ছে মিয়ানমার।
বড় শণখোলা ত্রাণশিবিরের রোহিঙ্গা ও নাইক্ষ্যংছড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থলমাইন বিস্ফোরণ সর্বশেষ ঘটেছে ২৬ সেপ্টেম্বর। এদিন বিকেলে নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা সীমান্তের ওপারে এক রোহিঙ্গা যুবক প্রাণ হারান।
চাকঢালা সীমান্তের বড় শণখোলায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নূর মুহাম্মদ (৪৫) জানান, সীমান্তে শুধু কাঁটাতারের বেড়া নয়, যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ চলাচল করে এবং রোহিঙ্গারা যেসব রাস্তা ধরে বাংলাদেশে আসছে, সেই সব জায়গায় মাইন ও বিস্ফোরক পুঁতে রাখা হয়েছে।
বিজিবি কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার ও নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আনোয়ারুল আযীম বলেন, ‘যেহেতু ঘটনাগুলো সীমান্তের ওপারে ঘটছে, সে জন্য স্পষ্ট করে বলতে পারছি না, এসব মাইন, না বিস্ফোরক। তবে এগুলো যে উচ্চক্ষমতার বিস্ফোরক, তা বোঝা যাচ্ছে। এ নিয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত চারবার প্রতিবাদ জানানো হলেও মিয়ানমার কোনো সাড়া দেয়নি।’
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল বলেন, স্থলমাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে। এটা দুই দেশের ব্যাপার। স্থানীয় প্রশাসনের কিছু করার নেই।
সীমান্তে দায়িত্বরত এক বিজিবি সদস্য বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে ২৭ সেপ্টেম্বরও স্থলমাইন পুঁততে দেখা গেছে মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের।
বান্দরবান জেলা পুলিশ ও বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, শূন্যরেখায় পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে গত এক মাসে নাইক্ষ্যংছড়ির আদর্শগ্রামের বাসিন্দা হাশিম উল্লাহ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সৈয়দ আহমদ, মোক্তার আহমদ, গোল চেহের বেগম, নূরে আলমসহ অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত সপ্তাহে বলেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর নিষিদ্ধ অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন পেতে রেখেছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। এ ধরনের মাইন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
স্থলমাইন নিষিদ্ধকরণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু ব্যান ল্যান্ড মাইনস (আইসিবিল)’-এর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রাখছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে।
কক্সবাজারের বাসিন্দা এবং সীমান্তে স্থলমাইনবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রফিক আল ইসলাম বলেন, হতাহতের ধরন দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, বর্তমানে মিয়ানমার পিএমএন-১ মডেলের স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এগুলোর বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হয়েছেন।