অনানুষ্ঠানিক পথ ব্যবহারেই কমছে প্রবাসী আয়
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এখন একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতে। গেল কয়েক বছরে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশ ও ভারতে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশে কর্মী কমে গেছে, এমনটা মূল কারণ নয়। বরং অর্থ পাঠানোর অনানুষ্ঠানিক পথ ব্যবহার করা হচ্ছে, এটিই মূল কারণ। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসারও অন্যতম আরেকটি কারণ বলে মনে করছেন তাঁরা। সমস্যা সমাধানে নতুন প্রযুক্তি যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। আয়ও করছেন। তবে সেই বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না, যা প্রবাসী আয় কমার পেছনে এখন মূল কারণ। অনানুষ্ঠানিক পথে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে।’
বিষয়টি সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন এমন একজন প্রবাসী দেশে ডলার পাঠাবেন। তিনি সেখানকার কোনো এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তাকে ১০০০ ডলার দিলেন। ওই এজেন্ট সেই ডলার রেখে দিলেন। তিনি বাংলাদেশে তাঁর এজেন্টকে বললেন সমপরিমাণ টাকা ওই ব্যক্তির পরিবারকে দিয়ে দিতে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না।
এর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা পড়ছে? জানতে চাইলে আহসান এই মনসুর আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের উপার্জিত অর্থ আমাদের কাছে আসছে না। স্পষ্টতই তা প্রভাব ফেলছে আমাদের বিনিয়োগে, বৈদেশিক রিজার্ভে। ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যার অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এসব ক্ষেত্র মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা বোধ তৈরি হলে বিষয়টি এমন থাকবে না।’
২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠান ১ হাজার ২৭৬ কোটি ডলার। আর তারও আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) প্রবাসী আয় আসে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। এই অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল আড়াই শতাংশ। অবশ্য চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশও প্রবাসী আয়ের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। মোট প্রবাসী আয়ের ৬০ শতাংশই আসে এসব দেশ থেকে। একমাত্র কাতার ছাড়া বাকি সব উপসাগরীয় দেশ থেকেই প্রবাসী আয় হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও কুয়েত থেকে প্রবাসী আয় আসা কমেছে সবচেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, নতুন করে এসব দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সৌদি আরবের বাজার খুলেছে। কুয়েতেও আলোচনা চলছে। খুবই ইতিবাচক হচ্ছে, অধিক সংখ্যক নারী শ্রমিক যাচ্ছেন বিদেশে। তবে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ আসার ব্যবধানের কারণেই প্রবাসী আয় কমছে আমাদের। হুন্ডিতে উল্লেখযোগ্য হারে অর্থ আসা বেড়েছে।
ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, দুটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে বিনিময় হারের ব্যবধান। আনুষ্ঠানিক হারে টাকা পাঠালে ১ ডলারে হয়তো ৮০ টাকা পাওয়া যায়। অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে পাঠালে ১ ডলারে ৮৩ টাকা পাওয়া যায়। এ ব্যবধানের কারণে প্রবাসী আয় কমছে। ২. ব্যাংক ফি। অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ পাঠালে ব্যাংক ফি দিতে হয় না। এ ছাড়া প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতিরই ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এই বিষয়ে আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংটা কম।
বলা হয়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার প্রভাব পড়েছে আমাদের প্রবাসী আয়ে। বিষয়টি সঠিক নয় বলে মনে করেন ওয়াজিদ হাসান শাহ। তিনি বলেন, এ রকম হলে সে দেশে চাকরি হারাতেন আমাদের দেশের কর্মীরা। বরং কর্মী সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। তাহলে এটা কীভাবে বলা যায়? কারেন্সি ফ্ল্যাকচুয়েশন বা বৈদেশিক মুদ্রা যেমন পাউন্ড, ইউরোর দর কমে যাওয়ার কারণে প্রবাসী আয়ে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তবে মোবাইল বেইজড মানি ট্রান্সফার ব্যবস্থাকে ব্যাংকিং মাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত করে যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করা গেলে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর বিষয়টি সহজ ও কম ব্যয়বহুল হবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আমাদের আরও ডায়নামিক হওয়া প্রয়োজন। ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানোর কার্যকারিতা আমরা এ যাবৎ পর্যন্ত ভালোই পেয়েছি। তবে যদি মোবাইলভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে আরও বিধিবদ্ধ করা যায়, তাহলে সরকারের কাছে বৈদেশিক আয় পৌঁছাবে। ব্যাংকিং মাধ্যমের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে মোবাইলভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস যৌথভাবে অর্থ পাঠাতে পারে।’
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সন্ত্রাসী অর্থায়নের ঝুঁকির কারণে অনেক দেশ থেকে এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সরাসরি অর্থ পাঠানো যায় না। দেখা যায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অনেক তথ্যাদি চাওয়া হয়। বাড়তি ফি-ও দিতে হয়। এতে যাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তারা নিরুৎসাহিত হন। যেমন একই ব্যক্তির ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে নেপালে অর্থ পাঠাতে বাংলাদেশের চেয়ে কম খরচ হয়। তাই নতুন প্রযুক্তিতে উৎসাহ দিয়ে যথাযথ উপায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন।