গোলাম আযমের আপিল

golam azamরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বেকসুর খালাস চেয়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৯০ বছর দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম।

তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানান, সোমবার তারা সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আপিল জমা দিয়েছেন।

অপরাধ বিবেচনায় ‘সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য’ হলেও ‘বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায়’ গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, সহযোগিতা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়া- এই পাঁচ ধরনের অপরাধের প্রতিটিই প্রমাণিত হয় জামায়াতে ইসলামীর মুক্তযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

রায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর  বলেন, “তার যে অপরাধ এর সবগুলোই সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি আছেন। তার বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এই সাজা দেয়া হয়েছে।”

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দমনের জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শান্তি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী গঠন এবং সেগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় সভা করেন। এ দুটি অভিযোগে প্রতিটিতে তাকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানি দেয়ার ২৮টি ঘটনার কথা বলা হয়। চতুর্থ অভিযোগে ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা। এ দুটি অভিযোগের প্রতিটির জন্য তাকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির যুদ্ধকালীন প্রধানের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগ ছিল পুলিশ কর্মকর্তা সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দেয়, যার জন্য তাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

রায়ের দিন থেকেই প্রতিটি অপরধের সাজা একের পর এক কার্যকর হবে বলেও ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়েছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; নাগরিকত্বও ফিরে পান। ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন।

গোলাম আযম ফেরার পর থেকেই একাত্তরের ভূমিকার জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণ আদালতে প্রতীকী বিচার ও ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি চূড়ান্ত রূপ পায়।

সে সময় ক্ষমতাসীন সরকার সেই দাবিতে সাড়া না দিলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে বহু প্রতীক্ষিত সেই বিচার কাজ শুরু হয়।

২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর ভিত্তিতে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ২০১২ সালের ১১ই জানুয়ারি গোলাম আযমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হয়েছে।

এরপর পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে গত বছরের ১৩ মে জামায়াতের এই সাবেক আমিরের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হলেও গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।

ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

সেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি সহিংস রূপ নেয়। বিচারের বিরোধিতাকারী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো।

এরই মধ্যে গত ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

পঞ্চম রায়ে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর ষষ্ঠ রায়ে জামায়াত নেতা মুজাহিদকে মৃতুদণ্ড দেয়া হয়।

কাদের মোল্লার মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়গুলোর বিরুদ্ধে উভয়পক্ষের আপিল শুনানি শেষে বর্তমানে রায়ের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। অন্যদিকে সাঈদীর মামলার শুনানি আগামি ১৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া শুনানি শুরুর প্রক্রিয়াগত কাজ এগোচ্ছে কামারুজ্জামানের মামলায়।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ