যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ করা এত কঠিন কেন ?

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বন্দুকের গুলিতে খুনের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খুনের পেছনে থাকে একজন মানুষ, প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত রাগ বা ক্ষোভ থেকে, অথবা মানসিক অসুস্থতা থেকে ঘটে থাকে এসব ঘটনা। গত রোববার লাস ভেগাসে এক উন্মুক্ত কনসার্টে যে অভাবিত হত্যাকাণ্ড ঘটে, সেটি ছিল এ বছরের ২৭৫ দিনে ২৭৩তম গণখুনের ঘটনা। ৬৪ বছর বয়স্ক এক আপাত-সুস্থ ব্যক্তির এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে এ পর্যন্ত নিহত লোকের সংখ্যা ৫৮–তে দাঁড়িয়েছে। আহত হওয়ার সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। লাস ভেগাসের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭০০। বছর শেষ হতে এখনো আরও তিন মাস বাকি।
প্রতিবারই যখন কথাও বড় কোনো গণখুনের ঘটনা ঘটে, তার পরপরই এ দেশের চারদিকে আওয়াজ ওঠে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাঁচ বছর আগে কানেকটিকাটের এক প্রাথমিক স্কুলে এক যুবকের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে ২৬ জন শিশুর মৃত্যুর পর জোর আওয়াজ উঠেছিল, এখনই একটা কিছু করতে হবে। গত বছর এক আফগান যুবক অরল্যান্ডোর এক নাইট ক্লাবে গুলি চালিয়ে ৪৯ জন নারী-পুরুষকে হত্যার পর ফের সেই একই আওয়াজ উঠেছিল। এমনকি এই দাবি নিয়ে কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা রাতভর আইনসভা কক্ষ ঘেরাও পর্যন্ত করে রেখেছিলেন। কিচ্ছু হয়নি। এবারও একই দাবি উঠেছে, ‘সুবুদ্ধিসম্পন্ন’ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করতে হবে। একজন ডেমোক্রেটিক সিনেটর বলেছেন, যাঁরা বিপক্ষে, তাঁদের পশ্চাদ্দেশে গুঁতো মেরে হলেও একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু এ কেবল কথার কথা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে এ পর্যন্ত কে কোন উদ্যোগ নিয়েছে, তার এক ফিরিস্তি দিয়ে সাবেক ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান স্টিভ ইসরায়েল নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক নিবন্ধে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এবারও কিছু হবে না।
সুবুদ্ধিসম্পন্ন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সারা দেশের অধিকাংশ মানুষ একমত হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয় না, তার প্রধান কারণ এ দেশের ‘গান লবি’। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ আমেরিকার মানুষের অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে প্রধান লবিং গ্রুপ। কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যকে প্রভাবিত করার জন্য এরা বছরে প্রায় ২৫ কোটি ডলার খরচ করে থাকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে এমন প্রার্থীদের পক্ষে তারা সরাসরি খরচ করেছে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। এনআরএর যুক্তি, অস্ত্র হাতে একজন বাজে লোককে ঠেকানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো একজন ভালো লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। ভয়ের কথা হলো, এনআরএর এই প্রচারণায় আমেরিকার মানুষ ক্রমেই বিশ্বাস করা শুরু করেছে। আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, অথচ নিজের ঘরে অস্ত্র থাকলে নিরাপদ থাকা যায়, এনআরএর এই যুক্তি সমর্থন করে দেশের অধিকাংশ মানুষ।
অস্ত্রের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৭৯১ সালে গৃহীত মার্কিন শাসনতন্ত্রের দ্বিতীয় সংশোধনীতে এ দেশের নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশি বা বিদেশি যেকোনো সরকারের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে নিজের আত্মরক্ষার জন্য ‘সুনিয়ন্ত্রিত’ মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রত্যেক নাগরিককে অস্ত্র বহনের অধিকার দেওয়া হলো। এ কথা এমন এক সময়ের, যখন আমেরিকা সদ্য এক ঔপনিবেশিক যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তখনো এমন ক্ষমতা ছিল না যে সব নাগরিকের নিরাপত্তা সে নিশ্চিত করবে। সে কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে, এরা নিজস্ব মিলিশিয়া গঠন করতে পারত ও প্রয়োজনবোধে নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারত।
সে প্রায় সোয়া ২০০ বছর আগের কথা। আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে যারা, এনআরএ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, সবাই এই দ্বিতীয় সংশোধনীর কথা বলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের সব যুক্তি এককথায় বাতিল করে দিয়ে থাকেন। গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় হিলারি ক্লিনটন সুবুদ্ধিসম্পন্ন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব রেখেছিলেন। বন্দুক কেড়ে নেওয়া নয়, বন্দুক যাতে মন্দ লোকের হাতে না পড়ে, তিনি কেবল সে কথাই বলেছিলেন। জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, হিলারি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনই তিনি আপনাদের বন্দুক কেড়ে নেবেন। হিলারি প্রেসিডেন্ট হননি, হয়েছেন ট্রাম্প। শপথ নেওয়ার পর ট্রাম্প তাঁর এনআরএর বন্ধুদের সোল্লাসে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, হোয়াইট হাউসে এখন থেকে আপনাদের একজন বন্ধু রয়েছে।’
প্রায় ১০০ বছর আগে প্রথম যখন এনআরএর প্রতিষ্ঠা হয়, তখন আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে যুক্তি ছিল, এর প্রধান ব্যবহার হবে শিকারের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের অঙ্গরাজ্যগুলোতে বন্দুক হাতে শিকারে যাওয়া একটা জনপ্রিয় খেলা। কোনো কোনো রাজ্য আছে, যেখানে বছরে একটি নির্দিষ্ট দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শিকার মৌসুম’ শুরু হয়, কোথাও কোথাও এই মৌসুমের প্রথম দিন স্কুল ছুটি পর্যন্ত দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য অস্ত্র বহনের জনপ্রিয়তা শুধু শিকারের জন্য নয়, বর্ণভিত্তিক সহিংসতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধির কারণেও বেড়েছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়ছে, খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁদের ‘অপরাধী’ ও ‘ধর্ষক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন মানুষের অভাব নেই, যাঁরা মনে করেন, এসব অপরাধীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে অস্ত্র রাখা জরুরি। অনেক রাজ্যেই নিজের সঙ্গে অস্ত্র বহনের অধিকার দেওয়া হয়েছে, এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত গুলিবোঝাই অস্ত্র বহন করা যাবে। কোনো কোনো রাজ্য আছে, যেখানে আপনার দরজায় যদি অপরিচিত কেউ কড়া নাড়ে, গৃহস্থের সন্দেহ হলে তিনি নির্বিঘ্নে গুলি চালাতে পারেন। তাঁর কেশাগ্রও কেউ ছুঁতে পারবে না। পাঁচ বছর আগে ১৭ বছরের নিরস্ত্র ও নিরপরাধ কিশোর ট্রেভর মার্টিনকে গুলি ছুড়ে হত্যার পর বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিলেন ২৮ বছরের এক খুনি।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বর্ণভিত্তিক বিভক্তি যত বেড়েছে, আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে ওকালতি তত বিস্তৃত হয়েছে। রক্ষণশীল রিপাবলিকান দল অস্ত্র বহনের অধিকারকে প্রত্যেক আমেরিকানের মৌলিক একটি অধিকার হিসেবে মনে করে। এনআরএর চাপেই হোক অথবা নিজেদের দলীয় সমর্থকদের খুশি রাখতেই হোক, অস্ত্র বহনের যেকোনো অধিকার সংকুচিত হয়, তাঁরা এমন যেকোনো চেষ্টার বিপক্ষে। ২০১১ সালে ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য গ্যাবি গিফোর্ড গুলিতে আহত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলের চাপে কংগ্রেসে প্রায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের
জন্য ১০০-এর মতো প্রস্তাব উঠেছিল। সেসবের একটিও গৃহীত হয়নি। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা চেষ্টা করেছিলেন সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ হোক। পারেননি। সন্ত্রাসী হিসেবে সরকারি তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা যাতে অস্ত্র কিনতে না পারে, ওবামা তার প্রস্তাব করেছিলেন। সেটিও ধোপে টেকেনি।
চলতি প্রশাসনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আইন পাস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সে কথা বলাই বাহুল্য। বরং চেষ্টা চলছে কীভাবে চলতি নিয়ন্ত্রণবিধি শিথিল করা যায়। মার্কিন কংগ্রেসে এক প্রস্তাব উঠেছে, যা গৃহীত হলে আগ্নেয়াস্ত্রে ‘সাইলেন্সার’ ব্যবহার করা যাবে। বলা হয়েছে, গুলি ছোড়ার সময় বড্ড আওয়াজ হয়, তাতে ধরা পড়ার আগেই শিকার পালিয়ে যায়। লাস ভেগাসে হোটেলের যে কক্ষ থেকে সেই খুনি একের পর এক গুলি ছুড়ে অন্তত ৫৮ জনকে খুন করে, গুলির শব্দ শুনেই পুলিশ সে ঘর ভেঙে সেখানে প্রবেশ করে। যদি তার সেমি-অটোমেটিক বন্দুকে সাইলেন্সার থাকত, তাহলে আরও কত মানুষ যে নিহত হতো, তা কে বলতে পারে।
আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অধিকারকে যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই ‘পবিত্র’ এক অধিকার ভাবা হয় যে ১৯৯৬ সালে গৃহীত এক আইন অনুসারে জনস্বাস্থ্য ও আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে হত্যাকাণ্ডের কী সম্পর্ক, তা নিয়ে কোনো রকম গবেষণার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন অদ্ভুত আইনের উদাহরণ নেই।
অথচ অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার কথা কেউই বলছে না। যাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, তাঁদের বক্তব্য, রাস্তায় কীভাবে গাড়ি চালাবেন, সে জন্য আইন রয়েছে। তাতে কারও গাড়ি চালানোর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় না; বরং অহেতুক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। সিটবেল্ট বাঁধার নিয়ম হয়েছে, অথবা গাড়ি চালানোর সময় টেক্সট করার ওপর কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে, এতে মানুষের জীবন বাঁচছে। গাড়ি চালানোর ওপর নিয়মবিধি জারি করা গেলে অস্ত্র বহনের ওপর কেন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না?
লাস ভেগাসের হত্যাকাণ্ডের পর এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শোক প্রকাশ করেছেন। শোক ও প্রার্থনার কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের অনেক বাঘা বাঘা নেতাও। কিন্তু শুধু শুকনো কথার শোক জানিয়ে কি পরবর্তী গণখুন বন্ধ করা যাবে? মনে হয় না।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ