রাজপালঙ্কে ঘুমান কর্মচারী
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রাজবাড়ি বলে কথা! দেশ-বিদেশের দুর্লভ প্রজাতির সব গাছ এনে লাগানো হয়েছিল। তবে সেসব গাছ আর থাকবে কি না, সংশয় দেখা দিয়েছে। নাটোরের উত্তরা গণভবনের আঙিনার ভেতরে এসব প্রাচীন গাছ কেটে সাবাড় করে দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, এই রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপূর্ত বিভাগই মূল্যবান গাছগুলো লোকদেখানো দরপত্রের মাধ্যমে কেটে নিচ্ছে। আবার এই দপ্তরের কর্মীরা গণভবনের ভেতরে আবাস গেড়ে বসেছেন। কেউ কেউ ভেতরে গরু-ছাগল পালছেন। এক কর্মচারী আবার রাজপ্রাসাদের ঐতিহাসিক খাট নিজের মতো করে ব্যবহার করছেন।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছেন। এতে তিনি রাজপ্রাসাদকে ঐতিহাসিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) এবং প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এর ভেতরে কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন এবং গরু-ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। কোন বিধিবলে তাঁরা কত দিন থেকে সেখানে বসবাস করছেন, তা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে হবে। কিন্তু ১৬ দিনেও জবাব আসেনি।
জানতে চাইলে উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব নাটোরের এনডিসি অনিন্দ্য মণ্ডল বলেন, কমিটিকে না জানিয়েই গণপূর্ত বিভাগ গাছ কেটেছে। বিষয়টি জানার পরপরই তাঁরা গাছ কাটা বন্ধ করতে চিঠি দিয়েছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আজ মঙ্গলবার একটি সভা ডাকা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় ১৯৪৫ দাগের ৪১ দশমিক ৫০ একর জমির ওপরে এই রাজবাড়ি অবস্থিত। বর্তমানে এটি এক নম্বর খাসখতিয়ানভুক্ত সম্পত্তি। দিঘাপতিয়ার সর্বশেষ রাজা কুমার প্রভুনাথ ভারতে চলে গেলে ১৯৫৬ সালে প্রশাসন রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৭ সালে সরকার এ রাজপ্রাসাদকে ‘গভর্নর হাউস’ ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেটিকে গণভবনে রূপান্তর করেন। একাধিকবার এখানে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক হয়েছে। রাজপ্রাসাদের আঙিনার ভেতরে তিন শতাধিক আমগাছ, ২৫৬টি নারকেলগাছ, ১৫০টি সুপারিগাছসহ ১২ রকমের মৌসুমি ফলের গাছ রয়েছে। এ ছাড়া প্রসাদের ভেতরে ‘ইতালিয়ান গার্ডেন’-এ রয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এনে লাগানো দুর্লভ প্রজাতির গাছ। গণপূর্ত বিভাগের দাবি, গণভবনের আঙিনার ভেতর থেকে মরা ও ঝরে পড়া কিছু গাছের ডালপালা দরপত্রের মাধ্যমে তারা কেটেছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, গণভবনের বিপুলসংখ্যক গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর গুঁড়ি দায়িত্বরত পুলিশ, আনসার ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারীদের সামনে দিয়েই গণভবনের বাইরে নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে নাটোর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহম্মদ মশিউর রহমান আকন্দ বলেন, গাছ কাটার জন্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তাঁদের অনুমতি দিয়েছেন। বন বিভাগ ১৫ হাজার ১৯০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করেছিল। তাঁরা ১৮ হাজার ৫০৮ টাকার দরপত্র পেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, কাটা গাছগুলো গণভবনের ভেতরেই রয়েছে। কয়টি গাছ কাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়, তা বলতে পারেননি তিনি। তবে একটি সূত্র বলেছে, মাত্র তিনটি মরা গাছ কাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি বন বিভাগের কাছে যেতে বলেন।
ভ্যানে করে গাছ পাচার
গণভবনের গাছ লুটের বিষয়টি ধরা পড়েছে সম্প্রতি প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাটোরে আসার পর। তিনি গণভবনটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। গতকাল সোমবার দুপরে উত্তরা গণভবনের প্রধান ফটকের সিসি ক্যামেরার ১৮ দিনের (২৫ সেপ্টেম্বর-১২ অক্টোবর) ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, ১৬টি ভ্যানে করে তাজা গাছের গুঁড়ি নিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় পুলিশ ফটকের সামনেই বসা ছিল।
এ ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, যারা গাছ পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, আঙিনার বাগানের ভেতরটা জঙ্গলাকীর্ণ। এই বাগানে অন্তত ২০টি গাছ কাটা হয়েছে। বেশির ভাগ গাছের কাঠই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের ভেতরে ভ্যানগাড়ি যাতায়াতে রীতিমতো রাস্তা হয়ে গেছে। কয়েকটি জায়গায় তাজা গাছের ডাল কেটে নেওয়া হয়েছে। আর দুটি জায়গায় কেটে রাখা বেশির ভাগ গাছের গা থেকে কষ ঝরছিল। সেখানে যে পরিমাণ গাছের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখা গেল, তার মূল্যই দরপত্রের মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে।
দর মূল্যায়নের বিষয়ে বন বিভাগের নাটোর জেলা কর্মকর্তা এম এ আওয়াল বলেন, তাঁদের একজন কর্মকর্তা গাছের মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাঁর ভুলও হতে পারে, আবার ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। সেটা তদন্ত করা হবে। আর ওই প্রতিবেদন মৌখিকভাবে বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনিও মূল্যায়ন প্রতিবেদনের কোনো কাগজ দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
‘গ্র্যান্ড-মাদার হাউস’ এখন কর্মচারী নিবাস
গণভবনের ভেতরে গিয়ে গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারীদের আবাস ও তাঁদের গরু-ছাগল বিচরণ করতে দেখা গেল। বিষয়টি অবগত আছেন জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান আকন্দ বলেন, সেটা বন্ধ করতে তিনি নোটিশ দিয়েছেন। এমনকি গরু-ছাগল বের না করলে জব্দ করারও ঘোষণা দিয়েছেন। তবে একজন কর্মচারী যে রাজপ্রাসাদের ঐতিহাসিক খাট ব্যবহার করছেন, সেটা তিনি জানেন না।
গণভবনের ভেতরে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে একটি অংশে গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা করা হয়েছে। সেখানে ফটকে থাকা নির্দেশনায় লেখা আছে, ‘জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ’। এখানকার একটি বাসায় সপরিবারে থাকছেন গণপূর্ত বিভাগের তৃতীয় শ্রেণির অনিয়মিত কর্মচারী (ওয়ার্ক-চার্জ) আবদুস সবুর তালুকদার। একটি কক্ষে রাজপ্রাসাদের অন্যান্য খাটের মতোই একটি খাট দেখা গেল।
কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেল, কক্ষটি ‘গ্র্যান্ড-মাদার হাউস’। অর্থাৎ রাজাদের দাদিরা এখানে থাকতেন। ঘরের ওই খাটটি তাঁদেরই। পুরাকীর্তি হিসেবে খাটটি সংরক্ষণ করার কথা। সেটা স্পর্শ না করতে দর্শনার্থীদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। অথচ সেই খাটই ব্যবহার করছেন কর্মচারী সবুর। কাল খোঁজ করে তাঁকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তবে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। সবুর নিশ্চিত করেন, তিনি এখন রাজপ্রাসাদের ‘গ্র্যান্ড-মাদার হাউস’-এ বাস করছেন। ওই কক্ষে তাঁর আগেও অনেকে থেকেছেন। তাঁরাও খাটটি ব্যবহার করেছেন।