পুতিনই মধ্যপ্রাচ্যের খেলোয়াড়

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ইসরায়েলের জয়ের পর তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সঙ্গে দেখা করেন। ইসরায়েল তখন যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ওই বৈঠকে উপস্থিত রুশ কর্মকর্তা আনাতলি চেরনিয়ায়েভের তথ্যানুসারে ব্রেজনেভ ইসরায়েলকে নিজ সীমান্তের নিশ্চয়তা দিয়ে যুদ্ধবিরতি মানতে উৎসাহিত করতে চাচ্ছিলেন। যখন গ্রোমিকো বলেন যে আরবরা এতে মনে কষ্ট পাবে তখন ব্রেজনেভ গর্জে ওঠেন, ‘আমরা এত দিন ধরে আরবদের যৌক্তিক পথের সন্ধান দিয়ে আসছি। তারা যুদ্ধ চেয়েছে, সেটা তারা করুকগে…তারা নরকে যাক।’
ব্যাপারটা হলো আজকের আরব নেতা ও একনায়কেরা কত ভাগ্যবান। তাঁদের এখন সোভিয়েত নেতার সঙ্গে কথা বলতে হয় না, বলতে হয় রুশ নেতার সঙ্গে। তাঁদের সামনে আছেন একজন যোগ্য, কেউ বলেন খুবই যোগ্য একজন নেতা, যাঁর নাম ভ্লাদিমির পুতিন। আরব নেতারা এখন তাঁর ওপর ভরসা করতে পারেন। দোদুল্যমান ওবামা ও খ্যাপাটে ট্রাম্প এক অসম্ভব কাজ করেছেন। সেটা হলো তাঁরা পুতিনকে রুজভেল্ট ও আইসেনহাওয়ার বানিয়ে দিয়েছেন।
পুতিনের সেনারা সিরিয়ায় আইএসের হুমকি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তারা বাসার আল–আসাদের জন্য হুমকি—এমন শক্তিকেও গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। রুশিরা শুধু আসাদের শত্রুদের বোমা মারছে না বা সিরিয়ার সেনাদের পুনঃসশস্ত্রীকরণ করছে না, এমনকি তারা যুদ্ধবিরতি আয়োজনেও সহায়তা করছে। আমি রুশ সেনাদের আল-নুসরাসহ অন্যান্য সশস্ত্র ইসলামি যোদ্ধাদের নিয়ে হোমস শহর থেকে আল-বাবের ফ্রন্ট লাইন পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেখেছি। রাশিয়ার সাঁজোয়া যানগুলো ওই লাইনের উভয় পাশে সিরিয়া ও তুরস্কের দখলদার সেনাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল—আমি নিজের চোখে তা দেখেছি।
পুতিন ব্রেজনেভের যুগ থেকে কিছু চালাকি শিখেছেন। ব্রেজনেভ ছিলেন দেউলিয়া প্রকৃতির। তিনি যেমন আফগান যুদ্ধে কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলের ঘাঁটিতে তাজিক মুসলমান সেনাদের মোতায়েন করেছিলেন, তেমনি পুতিন পালমিরায় চেচেন মুসলমান সেনাদের মোতায়েন করেছেন। কিন্তু এই রুশি সেনারা তো আর আফগানিস্তানে কলঙ্কিত হওয়া সোভিয়েত সেনা নয়। এখন কর্মকর্তাদের অনেকেই সাবলীল আরবি বলতে পারেন, আর খেয়াল করবেন, তাঁরা বেশ ভালো ইংরেজিও বলতে পারেন। পুতিন জানেন কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার শক্তিমত্তা নিরূপণ করতে হবে। এই অঞ্চলে মস্কোর পতাকা ও ঘাঁটি গাড়তে পেরে তিনি আনন্দিত। তিনি তুরস্ক, ইসরায়েলসহ আরব বিশ্বে সাবেক প্রুসীয় রাজনীতিক বিসমার্কের মতো খেলতে চান।
এদিকে মিসরের ফিল্ড মার্শাল প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি পুতিনকে কায়রোর এক অপেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এ বছরই তিনি আবার ইরান সফর করবেন। অন্যদিকে তিনি আস্তানায় আসাদের অনুগত ও বিরোধীদের একইভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি যেমন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্রেমলিনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর সোভিয়েত বংশোদ্ভূত ও বর্ণবাদী প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিবারম্যানকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই লিবারম্যান একবার ফিলিস্তিনি বন্দীদের মৃত সাগরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। এমনকি সৌদি বাদশাহ সালমানও দলবল নিয়ে রাশিয়া সফর করে গেছেন।
রুশি বিমানবাহিনীর সিরিয়ায় বোমাবর্ষণ নিয়ে লোকে যা-ই বলুক না কেন, মস্কোর খেলোয়াড়েরা তা গায়ে মাখান না। কিন্তু ইউক্রেন, ক্রিমিয়া ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে পুতিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিকের বেশ ধারণ করতে পারেন। এসব পুতিনের ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। তিনি যখন ড্রেসডেনে কেজিবির কর্মকর্তা ছিলেন, তখন তাঁর প্রজ্ঞার ঘাটতি ছিল। কিন্তু এখন তিনি সিরিয়ায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাবহির্ভূত কর্মকর্তাদের সেখানে পাঠাচ্ছেন, যারা সরাসরি ক্রেমলিনের কাছে দায়বদ্ধ। মনে হয়, তিনি কিছু শিখেছেন।
এবার বাদশাহ সালমানের রাশিয়া সফরের প্রসঙ্গে আসি। এই লোকটির রাজ্য সৌদি আরব আইএস, তালেবান ও আল-কায়েদার মতো একই বিশুদ্ধবাদী ওয়াহাবি বিশ্বাসের অনুসারী। তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ের প্রাথমিক চুক্তি করেছেন। বাদশাহ সেখানে দীর্ঘ বক্তৃতায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তা প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়া যুদ্ধোত্তর সিরিয়ার পুনর্গঠনে সৌদি আরবকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যদিও পুনর্গঠনের মূল কাজটা করবে রাশিয়া আর টাকা দেবে সৌদি আরব, যদিও ক্ষমতায় আসাদই থাকছেন। ফলে ৩০ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি করার পরও ট্রাম্পের নিশ্চিত থাকার সুযোগ নেই।
পুতিন সৌদি আরবের দুর্বলতা সম্পর্কে জানেন। সেটা হলো ইয়েমেনে তাঁর লজ্জাকর যুদ্ধ ও রাজতন্ত্রের ওপর আঘাত। এ ছাড়া বাদশাহর মস্কো সফরের আগে প্রাসাদের বাইরে রহস্যজনক বোমা বিস্ফোরণ। এরপর সৌদি প্রেস এজেন্সি স্বীকার করে যে তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তি প্রাসাদে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। আর মনে রাখা দরকার, সিরিয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার প্রস্তাব যদি সৌদি আরব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে রাশিয়া যেকোনো সময় কাতারের দিকে ঘুরে যেতে পারে, যার সঙ্গে সৌদি আরব শিশুসুলভ বিবাদ বাধিয়ে রেখেছে।
কিন্তু ব্যাপারটা হলো একসময় আরব, ইরানি, তুর্কি ও এমনকি ইসরায়েলিরা অবশ্যই ভাববে, এসবের মধ্যে পুতিনের ব্যক্তিত্বের ছিটেফোঁটা আছে কি না। যেটা তিনি পৃথিবীকে দেখাতে চান: যোদ্ধা, শান্তি স্থাপনকারী, আলোচক ও সবার বন্ধু যারা রাশিয়ার জন্য হুমকি নয়। এরপর রাশিয়াকে কে বিমানঘাঁটি ও উষ্ণ পানিতে পোতাশ্রয় বানানোর প্রস্তাব দেবে? মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব দেবে বা মধ্যপ্রাচ্যের বন্দরে রুশ যুদ্ধজাহাজ আসার প্রস্তাব দেবে? আর শেষ ব্যক্তি হিসেবে কে পুতিনকে না বলবে?
কিন্তু পুতিন এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন না, সে তিনি যা-ই বলুন না কেন। তিনি ঝুঁকি নিয়েই যাচ্ছেন, সেটা শুধু সিরিয়ায় নয়। এক অর্থে তিনি এই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে খেলছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিনি মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। এখন কেউ কিছু করার আগে প্রথমে ভাববে, এতে পুতিনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকৃত অর্থে এ রকমই হয়।

                      রবার্ট ফিস্ক

দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ