চীনা উত্থানের চালক আঙ্কেল সি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ১৯তম কংগ্রেস শেষ হলো। সি চিন পিং দ্বিতীয় মেয়াদে প্রায় নয় কোটি সদস্যবিশিষ্ট দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। এর অর্থ হলো আগামী পাঁচ বছর তিনি চীনের প্রেসিডেন্টও থাকছেন—সাধারণ চীনারা কেউ কেউ যাঁকে ইতিমধ্যে আঙ্কেল সি বলতে শুরু করেছে—যদিও কেবল ৬৪-তে পড়েছেন তিনি।

একসময় চীনের শাসক দলের কংগ্রেস অনুষ্ঠানের সংবাদ বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের সামান্যই নজর কাড়ত। কিন্তু এবার সে রকম হয়নি। সি চিন পিংয়ের নবনির্বাচিত হওয়া গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বের সব প্রা‌ন্তে প্রচারমাধ্যমের প্রধান সংবাদ হয়ে উঠেছে। কেবল প্রচারমাধ্যমই নয়, সিপিসির এবারের কংগ্রেস নিয়ে এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত সর্বত্র বিপুল মনোযোগ লক্ষ করা গেছে।

এর কারণ বোধগম্য নয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হয়ে আছে; কিন্তু চীন ইতিমধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালকের আসনে উঠে এসেছে। সমগ্র বিশ্ব এই মুহূর্তে ধীরে ধীরে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে সেই লগ্নের জন্য, যখন চীন দ্বিতীয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তির জায়গা থেকে প্রথম স্থানে উঠে আসবে। সি চিন পিংয়ের এ মেয়াদের শেষে ২০২২ সালের মধ্যেই হয়তো সেই ঘটনাটি ঘটবে না। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আগামী বছর চীন অর্থনৈতিক গোলকায়নের পথে বিশ্বে আরও অনেক চমক দেখাবে। যার বিস্তর লক্ষণ ইতিমধ্যে গত পাঁচ বছরে আঙ্কেল সি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। যে উদ্যোগে এশিয়া, ওশেনিয়া, ইউরোপ এবং পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত ৬০টি দেশকে যুক্ত করেছেন সি। পুরো কর্মসূচিতে বিনিয়োগ হবে চার থেকে আট ট্রিলিয়ন ডলার। আর বিনিয়োগের জন্য সি গড়ে তুলেছেন বিশ্বব্যাংকের সমশক্তির বিকল্প ব্যাংক। এশিয়ায় কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ করিডরে চীনের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে এখন প্রায় ৫৭ বিলিয়ন ডলার। সুদূর আফ্রিকাতেও চীন তার বিনিয়োগ শক্তির পেশি দেখাচ্ছে মোমবাসা থেকে নাইরোবি পর্যন্ত ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসিয়ে।

কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রেসক্রিপশন ছাড়াই চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের নীতি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোর শাসকদের বিশেষ পছন্দ হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের এসব দেশ এত দিন উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের এক চিমটি বিনিয়োগ আর এক মুঠো রাজনৈতিক খবরদারিতে ক্লান্ত ছিল। সি চিন পিং তাদের কেবল সেই ক্লা‌ন্তি থেকেই মুক্তি দেননি—ওই সব দেশকে অবকাঠামোগত দারিদ্র্য থেকেও মুক্তি দিয়েছেন। যে কারণে সিপিসি দাবি করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা কেবল চীনের কোটি কোটি মানুষকেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে মুক্ত করেনি, বিশ্বের অন্যত্রও তাদের বিনিয়োগের সুযোগে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে।

এ রকম বাস্তবতাতেই সি চিন পিংকে ইতিমধ্যে মাও সে-তুং-পরবর্তী চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রথম দফায় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পূর্বে বিশ্ব প্রচারমাধ্যম তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানত। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চার বছরের পর জন্ম নেওয়া সি এবং তাঁর বাবা উভয়েই কমিউনিস্ট পার্টির বেশ পুরোনো সদস্য। সির পিতা একসময় পার্টির প্রোপাগান্ডা বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। সি নিজে দলের পূর্ণ সদস্য হন ১৯৭৪ সালে। তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে এই পিতা-পুত্র বেশ কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিলেন। সির ১৫ বছর বয়সে তাঁর বাবা পার্টির সিদ্ধা‌ন্তে কারাগারে নি‌ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। দেং জিয়াও পিংয়ের আমলে সি পরিবার আবার পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বলা যায়, দেংয়ের অর্থনৈতিক সংস্কারধর্মী চিন্তারই চূড়ান্ত ফসল সি চিন পিংয়ের উত্থান। এবারের কংগ্রেস শেষে মনে হচ্ছে, সি প্রভাবে দেংকেও ছাড়িয়ে গেছেন।

সি চিন পিংকে নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। তিনি কতটা সমাজতন্ত্রী, কতটা পুঁজিতন্ত্রী আর কতটা জাতীয়তাবাদী—এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আছে বিশ্বময়। তবে নিঃসন্দেহে তিনি বিপ্লব রপ্তানি করতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তাঁর আমলেই চীন বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশটির মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। স্পষ্টত সি চালিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন মৌলিকভাবে দেংয়ের নীতি দ্বারা।

দেংয়ের চিন্তার মূলকথা ছিল বিপ্লব বিকশিত হবে বস্তুগত লাভের ওপর দাঁড়িয়ে। উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে খাপ খায় না, এমন সব উপরিকাঠামো এবং উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন দেং। যে উদ্যোগের ফলেই চীনে বিগত প্রায় তিন দশক ধরে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল।

ঐতিহাসিক সেই পাটাতনের ওপরই দাঁড়িয়ে আছেন সি। চীনের অভ্যন্তরে গত পাঁচ বছর সির নেতৃত্বের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল মনোযোগ আকর্ষণী। প্রথম ঘটনা ছিল শক্ত হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে পুঁজি ও মুনাফার মধ্যে কিছু সহজাত অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা তৈরি হয়। স্বভাবত ‘চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্রে’ও বিলিয়নিয়ার যত বাড়ছে, দুর্নীতিও তত বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। তবে সিসিপি এখন দুর্নীতির প্রশ্নে জিরো টলারেন্স নীতি নিচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ দেখা গেছে পলিটব্যুরোর সদস্য সান জেঙ্গচাইয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে। এত দিন যাকে সি চিন পিংয়ের উত্তরাধিকার মনে করা হতো—দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাঁকেও সরে যেতে হলো।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আগ্রাসী বিদেশনীতিরও জনক বলা যায় সিকে। দুই পূর্বসূরি জিয়াং জেমিন ও হু জিনতাওয়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক পরিসরে চিন পিংয়ের শক্ত ধাঁচের ইমেজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ধরন চীনাদের বিশেষ পছন্দ—যা স্পষ্টত জাতীয়তাবাদী আবেগে জারিত।

এ ছাড়া গত অর্ধদশকে দেশের সর্বত্র নতুন করে পার্টির প্রভাব বাড়িয়ে চলেছেন সি। পার্টির নিয়ন্ত্রণ সামান্যতম খর্ব হয়, এমন কোনোরূপ সংস্কারে দেখা যায়নি তাঁকে। চলতি ১৯তম কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে সাড়ে তিন ঘণ্টার ভাষণে আঙ্কেল সি স্পষ্টই বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী থেকে স্কুল পর্যন্ত সর্বত্র পার্টিই নেতা!’ এই নীতির ফল হয়েছে পার্টি ক্যাডারদের কর্তৃত্ব বেড়ে যাওয়া। একই নীতির আরেকটি ফল হয়েছে, পশ্চিমের চোখে চীনের মানবাধিকার রেকর্ড এখন স্মরণকালের মধ্যে খুবই খারাপ।

তবে সি যে আপাতত তাঁর এরূপ ‘রাজনৈতিক লাইন’ থেকে বিচ্যুত হবেন, তার কোনো লক্ষণ নেই। বিশেষ করে এমন একসময়ে এটা প্রায় অসম্ভব, যখন চীনের পার্টি তার পরবর্তী কংগ্রেসের আগের বছর ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠার এক শত বছর পূর্ণ করতে চলেছে। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও এটা এক অসামান্য উপলক্ষ। কারণ, এ বছর ২০১৭ সালে যখন রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে তখন রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি রুগ্‌ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকলেও চীনের পার্টি যখন শত বছর পূর্তি উদ্‌যাপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তারা বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার প্রায় অর্জনযোগ্য এক স্বপ্ন দেখছে।

তবে এ-ও সত্য যে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিসির আদর্শিক ও ব্যবহারিক অবস্থান কতটা সমাজতান্ত্রিক আর কতটাইবা পুঁজিতন্ত্রকে পুষ্ট করছে—এ নিয়ে গভীর বিতর্ক ক্রমে তীব্র হচ্ছে। বিশেষত এ তথ্য সমাজতান্ত্রিক চিন্তার জন্য অসহনীয় যে চীনে ইতিমধ্যে (২০১৬-এর হিসাব) ৫৯৪ জন বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে এবং যা ব্যক্তিসংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আবার একই সঙ্গে এ তথ্যও ভুলে যাওয়া চলে না যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গত তিন দশকে দেশের ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠিয়ে এনেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো যখন ক্ষমতাচ্যুত; তখন চীনের পার্টি কেন এবং কীভাবে নির্বিঘ্নে প্রায় ৬৮ বছর যাবৎ চীনবাসীর নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে, তা প্রকৃতই সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। সি এই অধ্যায়ের সর্বশেষ পুরুষ হলেও এর ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে দেংয়ের এই চিন্তার ওপর, ‘গ্রন্থ উপাসনা একটা রোগ; আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করার হিম্মত দেখাতে হবে।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ