বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্টো আচরণ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ব্যাংক চলে মূলত আমানতকারীদের অর্থে। আর উদ্যোক্তা-পরিচালক ছাড়াও ব্যাংকের মালিকানায় ভাগ আছে হাজার হাজার শেয়ারধারীর। অথচ তাঁদের না জানিয়েই একের পর এক ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই কাজে সব ধরনের বৈধতা দিচ্ছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের সরকারি ব্যাংক খাত মৃতপ্রায়। সরকারি খাতের একসময়ের ভালো ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া নতুন কয়েকটি ব্যাংকের টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে গেছে। ভালো চলছিল বেসরকারি ব্যাংক খাত। কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপে এই বেসরকারি ব্যাংক খাতও অস্থির হয়ে পড়েছে। দুই ব্যাংকে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর এখন ব্যাংকপাড়ার আলোচিত প্রশ্ন হচ্ছে ‘এর পরে কে?’ ব্যাংক খাতের অভিভাবক বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই উল্টো আচরণ করছে বলে ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। যেমন গত সোমবার সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে (এসআইবিএল) বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়। নিয়ম হচ্ছে পর্ষদে নতুন পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পরিবর্তন আনা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তা কার্যকর হবে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সময় নিয়ে থাকে। যেমন এক সপ্তাহ হয়ে গেল, বেসিক ব্যাংকের নতুন এমডির ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অথচ এসআইবিএলের ক্ষেত্রে রাত ১০টা পর্যন্ত কার্যালয় খোলা রেখে ওই দিনই অনুমোদন দেওয়া হয়। গত ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ছিল এ রকমই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ভালো চলছিল। কিন্তু কিছু ব্যাংকের চেয়ারম্যান এত বেশি প্রভাবশালী যে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাচ্ছে না। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক আইন অনুযায়ী চলবে। এতে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি দক্ষ হতে হবে। কোনো ধরনের অসততাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
তবে ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এই নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, বরং হস্তক্ষেপ বাড়ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। ফলে কেউ ভরসা করতে পারছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর।
অর্থনীতিবিদেরা ব্যাংক খাতকে একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বলেন। এই খাতের কোনো সংকট হলে তাকে রক্তক্ষরণের সঙ্গে তুলনা করেন। বাংলাদেশে এই রক্তক্ষরণ হচ্ছে বহুদিন ধরে। এই সরকারের সময়েই ব্যাংকের পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে। ঘটেছে একের পর এক কেলেঙ্কারি। যেমন হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারির হাত থেকে বাদ যায়নি শেয়ারবাজারও। দুবার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। এখন পরপর দুই বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা দখল আরেকটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭। সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতে, মুদির দোকানের মতো ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কেন এভাবে ব্যাংক দেওয়া হয়েছে? অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ব্যাংক দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের সমীক্ষাই হচ্ছে বাংলাদেশে এত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তারপরও অনুমোদন দেওয়া হয়। এতগুলো ব্যাংক নজরদারি করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের আছে কি না, সেই প্রশ্ন তো আছেই। এখন নতুন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আদৌ কিছু করতে পারবে কি না।
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম প্রথম থেকেই। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। পর্যবেক্ষক বসানো ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণেই কোনো কিছু করার সাহস দেখাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এসব ব্যাংকের মালিকেরা যা চাইছেন, সেটাই হচ্ছে। বারবার বলা সত্ত্বেও বেসিক ব্যাংক নিয়েও কিছু করা হচ্ছে না। এতে ব্যাংক খাত আরও খারাপ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি ভালো করতে প্রয়োজন এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। কিন্তু অভাব সেটারই।