জেল থেকে পালাতে ১০ লাখ টাকার চুক্তি
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ভুয়া জামিননামা দিয়ে শিশু অপহরণ মামলার এক আসামিকে জেল থেকে পালাতে সহায়তা করেছেন স্বয়ং ডেপুটি জেলার। সঙ্গে ছিলেন আদালত ও কারাগারের আরও কয়েকজন কর্মচারী। এ জন্য ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ টাকা।
শিশু অপহরণ করে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করা এই আসামি গত ৩১ আগস্ট সবার সামনে দিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই লাপাত্তা। পুলিশ এখন তাঁকে খুঁজছে। তাঁর নাম মিজানুর রহমান ওরফে মিজান মাতুব্বর। ২০১৫ সালের ১৭ মে র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কারাগারেই ছিলেন।
ভুয়া জামিনে শিশু অপহরণ মামলার আসামির মুক্তি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, সমাজে যখন দুর্নীতি বাড়ে, তখন তা সব ক্ষেত্রেই প্রসারিত হয়। আদালতের দুর্নীতিও তারই অংশ। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে মানুষের মনে পুরো ব্যবস্থাটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। মামলার নথি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ২ মে রাজধানীর স্টাফ রোড এলাকার ফ্লাইওভারের নিচ থেকে আবীর নামের ৮ বছরের এক শিশুকে একটি প্রাইভেট কার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় একদল অপহরণকারী। তারা শিশুটির পরিবারের
কাছে ১০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরে একাধিক ব্যাংকের মাধ্যমে ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং নগদ ২৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে অপহরণকারীরা আবীরকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় আবীরের মামা এনায়েত উল্লাহ বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁদের মধ্যে জেল থেকে পালানো আসামি মিজানুর রহমান ছাড়াও রেজাউল করিম ও নজরুল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশের পরিদর্শক কবির হোসেন ১২ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আর এ বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এ মামলার অভিযোগ গঠনের দিন।
আদালত সূত্র জানায়, এই মামলার ১২ জন আসামির মধ্যে ৮ জন কারাগারে আছেন। কিন্তু অভিযোগ গঠনের দিন কারা কর্তৃপক্ষ প্রধান আসামি মিজানুর রহমান ছাড়া বাকি সাতজনকে আদালতে হাজির করেন। আদালত থেকে প্রধান আসামিকে হাজির না করার ব্যাপারে জানতে চাইলে কেউ কিছু বলতে পারেননি। পরে আদালত থেকে কারাগারে ফোন করে জানা যায়, মিজানুর রহমান জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
জামিন না হওয়ার পরও কী করে ওই আসামি কারাগার থেকে বের হয়ে গেলেন, তা জানতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলারকে আদালত সশরীর হাজির হয়ে কারণ দর্শাতে বলেন। এরপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবির আদালতে হাজির হয়ে বলেন, গত ৩০ আগস্ট আদালতের আদেশের কপি মোহাম্মদ তৈয়ব নামে আদালতেরই এক কর্মচারী কারাগারে পৌঁছে দেন। সেই আদেশ হাতে পাওয়ার পর আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি এই আদেশের কপি আদালতে দাখিল করেন।
আদালতে জমা দেওয়া নথিতে দেখা যায়, এতে নিবন্ধন নম্বরসহ খায়রুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীর স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই নামে কোনো আইনজীবী নেই, নম্বরটিও ভুয়া।
শুনানি শেষে বিচারক ভুয়া জামিননামায় পালিয়ে যাওয়া আসামি মিজানুর রহমান মাতুব্বরসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এবং পলাতক আসামি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি ফোরকান মিয়া এ বিষয়ে বলেন, ট্রাইব্যুনাল থেকে মিজানুর রহমানের মুক্তির কাগজ কারাগারে পাঠানো হয়নি। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে জামিনের ছাড়পত্র পেলে প্রথমেই কারা কর্তৃপক্ষের উচিত সেটা যাচাই করা। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তা না করেই আসামিকে মুক্ত করে দেয়। আদালত এ ব্যাপারে থানায় নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেন। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এর স্টেনোগ্রাফার আনোয়ার হোছাইন বাদী হয়ে গত ১৭ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় ভুয়া জামিননামা দিয়ে জেল থেকে পালানোর অভিযোগে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কারা প্রশাসন এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করে।
জানতে চাইলে কারা প্রশাসনের সাবেক উপমহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, জামিননামা এলে তা যাচাই করে দেখার পরই কারাগার থেকে আসামি ছাড়ার নিয়ম। জামিননামা সঠিক কি না, সেটা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে খোঁজ নিতে হয়। আবার আসামি যদি দুর্ধর্ষ হয়, তাহলে আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার আগে এ তথ্য থানার পুলিশকে জানাতে হয়।
কোতোয়ালি থানার এসআই ও জেল পালানো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, তিনি প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন, জেলখানায় বসে মিজানুর রহমান একটি চক্রের সঙ্গে জেল থেকে পালানো নিয়ে মোটা টাকার চুক্তি করেন। চক্রটিকে তিনি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জেল থেকে পালানোর জন্য ওই চক্রের সঙ্গে আসামির ১০ লাখ টাকার চুক্তি হয়। ওই চক্রের লোকজন সব কাগজপত্র তৈরি করেন এবং আদালতের কর্মচারী দিয়েই সেই কাগজ কারাগারে পাঠান।
এদিকে, ভুয়া জামিনে কীভাবে আসামি পালাল, তার খোঁজ পেতে অনুসন্ধানে নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই সংস্থা আদালত ও কারাগারের কয়েকজন কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চক্রকে শনাক্ত করেছে। কারাগারের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের নৈশপ্রহরী মোহাম্মদ তৈয়ব ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৩২ মিনিটে ভুয়া জামিননামাটি নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। জামিননামার বার্তাবাহক হিসেবে তৈয়বের নাম কারাগারের নথিতে রয়েছে। ডেপুটি জেলার ফেরদৌস মিয়া জামিননামা গ্রহণ করেছেন বলে রাত আটটার সময় উল্লেখ করে সেখানে সই করেন। ফুটেজে আরও দেখা যায়, তৈয়ব কারাগারে আসার আগে ছয়টি জামিননামা হাতে নিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর অফিস সহায়ক কবির হোসেন কারাগারে আসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে আবদুস সালাম নামের এক কারারক্ষী ছিলেন। তাঁরা কারাগারের ভেতরে এসে নৈশপ্রহরী তৈয়বের সঙ্গে মিলিত হন। কবির ছয়টি জামিননামা নিয়ে কারাগারে যান। এগুলোর একটির স্মারক ব্যবহার করে ভুয়া জামিননামা তৈরির মাধ্যমে মিজানুর মুক্তি পান। আসল জামিননামায় প্রকৃত আসামিও মুক্তি পান।
জানতে চাইলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর অফিস সহায়ক কবির হোসেন ছয়টি জামিননামা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে ভুয়া জামিননামার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। নৈশপ্রহরী মোহাম্মদ তৈয়ব ভুয়া জামিননামা নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। জামিননামা না নিয়ে গেলে কারাগারের নথিতে কেন সই করলেন জানতে চাইলে তৈয়ব দাবি করেন, সই তাঁর নয়।
তবে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে একই স্মারকের দুটি জামিননামা একই সময়ে কারাগারে এলেও ডেপুটি জেলার ফেরদৌস মিয়া পরদিন ৩১ আগস্ট জাল জামিননামায় আসামি মিজানুর রহমানকে মুক্ত করে দেন। জামিননামার ভিত্তিতে আসামি মুক্ত করার ক্ষেত্রে দায়িত্বরত জেলারের অনুমতি নেওয়ার বিধান আছে, কিন্তু নথিপত্রে ওই সময় দায়িত্বরত জেলার মাহবুবুল ইসলামের কোনো সই নেই।
ভুয়া জামিননামার ব্যাপারে জানতে চাইলে ডেপুটি জেলার ফেরদৌস মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, যেখানে আদালতের লোক জামিননামা হাতে করে এনেছেন, সেখানে সেটাকে ভুয়া ভাবার কোনো কারণ নেই। এত দিন এভাবেই জামিননামা আদালত থেকে কারাগারে এসেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত অনুযায়ী, ভুয়া জামিনে বের হতে দেওয়ার যে চুক্তি হয়েছিল, তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর অফিস সহায়ক কবির হোসেন ও নৈশপ্রহরী মোহাম্মদ তৈয়ব। তাঁরা কারারক্ষী আবদুস সালামের মাধ্যমে ডেপুটি জেলার ফেরদৌসের সঙ্গে রফা করেন। ফেরদৌস একা নেন ৫ লাখ টাকা। বাকি ৫ লাখ টাকা সবাই ভাগ করে নেন। এই চক্রের সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ।
অপহৃত শিশুর পরিবার এখন আর দেশে নেই। অপহরণ ঘটনার পরই শিশুটিকে বিদেশে নিয়ে যায় তার পরিবার। পরিবারটি এখনো বিদেশেই বসবাস করছে। তবে অপহরণ মামলার বাদী আবীরের মামা এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘জেল পালানো প্রধান আসামি বের হয়ে আসায় আমরা আতঙ্কে আছি।’
কারাগারের সূত্র জানায়, এ ঘটনায় কারা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপমহাপরিদর্শক বজলুর রশীদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ভুয়া জামিননামা দিয়ে জেল থেকে পালানোর ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১৫ সালে ঢাকার আদালতে বিচারাধীন ৭৬টি মামলার ১০৬ জন আসামি বিভিন্ন সময়ে ভুয়া জামিন নিয়ে পালিয়ে যান। এ নিয়ে দায়ের করা মামলায় এ বছরের ২২ মার্চ পাঁচজনের ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।