শিশুদের সঙ্গে একি হচ্ছে !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: খেলতে খেলতে প্রতিবেশী এক যুবকের ল্যাপটপে হাত দেয় শিশুটি। ছোট্ট আঙুলের চাপে হয়তো মুছে যায় ল্যাপটপে থাকা একটি ভিডিও গেম। এই ‘অপরাধে’ সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন প্রতিবেশী দুই যুবক। এখানেই শেষ নয়, শিশুটিকে বস্তায় ভরে শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে হত্যার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যই বাঁচিয়ে দেয় শিশুটিকে। গত বুধবার সন্ধ্যায় নৃশংস এ ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বামনী গ্রামে।
শিশুটি উপজেলার বামনী গ্রামের দরজি দোকানি মো. সোহেলের ছেলে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিবেশী দুই যুবক রাকিব হোসেন (২৭) ও মো. রিফাতকে (২৫) আটক করেছে পুলিশ। এখন নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে শিশুটির চিকিৎসা চলছে।
নৃশংসতার আরেক ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। সেখানে কথিত মুঠোফোন চুরির অপরাধে এক কিশোরকে (১৫) দুদিন আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের রফিকপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। কিশোরকে গত মঙ্গলবার নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার নরসিংদীর শিবপুরে মুঠোফোন চুরির অভিযোগ এনে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ফুটফুটে এক কিশোরীকে। ২০১৫ সালে সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যার সেই দৃশ্য মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি। একই বছরে খুলনার আরেক শিশু রাকিবকেও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। শিশু–কিশোরদের ওপর নিষ্ঠুরতার এই তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে।
রায়পুরে নৃশংসতা
শিশুটির বাবা মো. সোহেল মুঠোফোনে বলেন, গত বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর ছেলেকে চকলেট দেওয়ার কথা বলে বাড়ির সামনে থেকে ডেকে নিয়ে যান প্রতিবেশী দুই যুবক। বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরে প্রথমে একটি স্কুলে নেওয়া হয় শিশুটিকে। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে তাকে মারধর করা হয়। পরে হত্যা করার জন্য শিশুটিকে বস্তায় ভরে স্কুলের পেছনের একটি শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকের ওপর ফেলে রাখা হয়। অন্যদিকে ছেলেকে দেখতে না পেয়ে তিনি স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে খুঁজতে শুরু করেন। রাত ৯টার দিকে স্কুলের পেছনে বাগানের শৌচাগারের ট্যাংকের পাশে বস্তার ভেতর ছেলেকে খুঁজে পান।
মো. সোহেল বলেন, তাঁর ছেলের মুখে স্কচটেপ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু মুখ থেকে লালা বের হওয়ার কারণে স্কচটেপ খুলে যায়। যে কারণে শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পান তাঁরা।
গত বুধবার রাতে শিশুটিকে উদ্ধারের পর প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকেরা।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক মো. নাছির বলেন, শিশুটির মুখে জখমের অনেক চিহ্ন আছে। বিশেষ করে তার বাঁ চোখে গুরুতর জখম হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে নোয়াখালীতে পাঠানো হয়েছে।
রায়পুরের বামনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসী খুঁজতে বের হওয়ায় শিশুটি বেঁচে গেছে।
এ বিষয়ে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আজিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে আটক করা হয়েছে। ল্যাপটপ থেকে ভিডিও গেম মুছে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিশুটিকে মারধর করেছেন বলে তাঁরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন।
গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটির তদন্ত চলছে বলে জানান রায়পুর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পংকজ কুমার দে। তিনি বলেন, শিশুটির সঙ্গে কথা বলার জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া স্কুলের যে কক্ষে শিশুটিকে নির্যাতন করা হয়, সেটি সিলগালা করে রেখেছেন তাঁরা।
বেগমগঞ্জে নিষ্ঠুরতা
নির্যাতনের শিকার কিশোর মো. আলাউদ্দিনের বাবা নেই। ছয় বছর আগে তার বাবা মারা যান। এরপর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তার। মা নূরজাহান সন্তানদের কথা ভেবে সাত মাস আগে গৃহকর্মীর চাকরি নিয়ে ওমানে গেছেন।
সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা গোলাম আজম বলেন, কিশোরের পিঠে আঘাতের অনেক চিহ্ন দেখেই বোঝা যায়, তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে।
গতকাল দুপুরে হাসপাতালে কথা হয় কিশোরের সঙ্গে। সে বলে, গত শনিবার দুপুরে একই বাড়ির শাহানা আক্তারের ঘর থেকে একটি মুঠোফোন চুরি হয়। এ সময় তাকে বাড়িতে ডেকে চুরি হওয়া মুঠোফোনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিছু জানে না বলার পরও তাকে ঘরে নিয়ে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। ভয়ে একপর্যায়ে সে মুঠোফোনটি চুরি করার কথা স্বীকার করে এবং ফোনটি হারিয়ে গেছে বলে জানায়। এ সময় শাহানার দুই ছেলেসহ আরও কয়েকজন তাকে পেটায়। পরে ওমান থেকে তার মা ফোন করার পর সোমবার রাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিশোরটির চাচা ইমন মাহমুদ বলেন, তাঁর ভাতিজাকে চুরির মিথ্যা অভিযোগে নির্মমভাবে পেটানো হয়। তাঁরা ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. নুরনবীকে জানান। তিনি বলার পরও তাঁর ভাতিজাকে ছাড়েনি তারা।
কিশোরকে মারধরের কথা স্বীকার করে শাহানা আক্তার মুঠোফোনে বলেন, ছেলেটি সম্পর্কে তাঁর ভাতিজা। মুঠোফোন চুরি হওয়ার পর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে সে স্বীকার করে। পরে তাঁর ছেলেরা ঘরে বেঁধে তাকে শলা দিয়ে পেটায়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. নুরনবী বলেন, তিনি ঘটনাটি শোনার পর থানার ওসিকে বিষয়টি জানান। ওসি তাঁকে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করতে না পারলে জানাতে বলেন।
এ ব্যাপারে বেগমগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান বলেন, ইউপি সদস্য তাঁকে একটি মুঠোফোন চুরি হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন, পুরো ঘটনা বলেননি। এখন নির্যাতনের শিকার কিশোরের পরিবার অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।