পাটের নতুন যুগে বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: লিকলিকে লম্বা পাটগাছ বাতাসে নুয়ে পড়ে, কিন্তু ভাঙে না। কারণ, এতে লিগনিন নামে একধরনের জৈব রাসায়নিক বেশি থাকে। তুলায় লিগনিন থাকে না বলে তা নরম ও তুলতুলে। কাপড় তৈরির বাজারে পাটের আঁশের চেয়ে তুলার সুতার দাম ও কদর বেশি।
তুলার মতো পাটের আঁশও যাতে নরম হয়, সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের লিগনিনের জন্য দায়ী জিনকে শনাক্ত করেছেন। এখন তাঁরা প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের এই অন্যতম অর্থকরী ফসলের লিগনিনের পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, পাটের আঁশের মান, দৈর্ঘ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী চারটি জিনের পেটেন্ট (কৃতিস্বত্ব) পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এ ছাড়া যেকোনো উদ্ভিদ বা ফল থেকে যাতে দ্রুত রস, জৈব জ্বালানি ও প্রসাধনী তৈরি করা যায়, সেই কাজেও সাফল্য পেয়েছেন ওই বিজ্ঞানী দল। এ জন্য তাঁরা একধরনের ছত্রাকের তিনটি জিন শনাক্ত করে সেগুলোর পেটেন্ট পেয়েছেন।
বিশ্ব কৃতিস্বত্ব কর্তৃপক্ষের (ডব্লিউআইপিও) কাছ থেকে পাট ও ছত্রাকের এই সাতটি জিনের কৃতিস্বত্ব পাওয়ার একটি অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। তা হচ্ছে বিশ্বের কোথাও এ নিয়ে কোনো বাণিজ্যিক গবেষণা হলে বাংলাদেশের অনুমতি নিতে হবে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী এই উদ্ভাবন থেকে কোনো আয় হলে তার একটি অংশ বা রয়্যালটি বাংলাদেশকে দিতে হবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও হংকং এবং ইউরোপের ২৮টি দেশ এই পেটেন্টকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ব্রাজিল এখনো তা দেয়নি।
পাট ও ছত্রাকের জিনের পেটেন্ট বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ তার কোনো গবেষণা প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক পেটেন্ট পাবে, এটা একসময় ছিল কল্পনা। কিন্তু বর্তমান সরকার বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এই সরকারের আমলে জামদানি ও ইলিশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করায় পাট ও ছত্রাকের জিনের পেটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ।
মাকসুদুল আলমের স্বপ্নযাত্রা এখন বাস্তব
পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচনের পরবর্তী সাফল্য হিসেবেই বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাট ও ছত্রাকের ওই জিনগুলো শনাক্ত করেছেন। এখন পেটেন্ট পাওয়ার পাশাপাশি এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন ও শিল্প-বাণিজ্যের কাজে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হলো।
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্ব একদল তরুণ গবেষক পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার প্ল্যান্ট-এর চলতি বছরের জানুয়ারি সংখ্যায় এই আবিষ্কারে সব বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি মারা যাওয়ার আগেই ওই সাতটি জিনের পেটেন্টের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে চলতি বছর থেকে একের পর এক এসব পেটেন্ট পাওয়া শুরু হয়।
ওই পেটেন্ট পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের আইনি পরামর্শক সংস্থা হোসেন অ্যান্ড খান অ্যাসোসিয়েটস এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা ফলি হগ ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছে। মূলত কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উদ্যোগে ওই গবেষণার আন্তর্জাতিক পেটেন্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়।
পাট ও ছত্রাকের সাতটি জিনের প্যাটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বে কোথাও নতুন জাতের বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে অর্থ দিতে হবে
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হোসেন অ্যান্ড খান অ্যাসোসিয়েটসের আইনজীবী মোতাহার হোসেন বলেন, যেসব দেশে ওই সাতটি জিনের পেটেন্ট পাওয়া গেছে, তার আর্থিক সুবিধা কীভাবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওই দুই আইনি পরামর্শক সংস্থা কাজ করছে। অন্য দেশগুলোতেও যাতে বাংলাদেশ পেটেন্ট পায়, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করছে।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, পাটের শনাক্ত চারটি জিন কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে চারটি নতুন জাত তৈরির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন বিজ্ঞানীরা। রবি এক ও দুই এবং শশী এক ও দুই নামের ওই জাত চারটির মধ্যে প্রথমটি ইতিমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে। এতে সাফল্যও পাওয়া গেছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে চাষ হবে।
পাটের আঁশের মান
পাটের আঁশের মধ্যে সাধারণত ১২ থেকে ১৪ শতাংশ লিগনিন থাকে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রাথমিকভাবে লিগনিনের পরিমাণ কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। এতে আঁশ নরম হবে। ফলে পাট দিয়ে শার্ট, প্যান্ট বা সমজাতীয় পোশাক প্রস্তুতের সুতা তৈরি করা যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিজ্ঞানীরা পাটের সুতা ও তুলার সুতা মিশিয়ে কাপড় তৈরি করছেন। সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন পোশাক প্রস্তুত হলেও তা বেশ শক্ত হওয়ায় খুব বেশি বাজার পাচ্ছে না। এমন সুতা মূলত দরজা-জানালায় ব্যবহৃত পর্দা, কার্পেট ও তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পাটের তৈরি জিনসের প্যান্ট ও অন্যান্য পোশাক তৈরি করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করলেও মূলত এর কাপড় প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করতে না পারায় বাজার বড় হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, এখন নতুন জাত তৈরির কাজ চলছে। এ থেকে তৈরি উন্নত মানের আঁশ পোশাকশিল্পে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
পাটের রোগ প্রতিরোধ
পাটের জিনোম তথ্য থেকে রোগ প্রতিরোধী জিন শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। এই জিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে পাটগাছকে রোগ প্রতিরোধী করা যাবে।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীরা জানান, কাণ্ডপচা রোগ হলে বেশির ভাগ পাটগাছ পরিপক্ব হওয়ার আগেই মারা যায়। এ ছাড়া ঢলে পড়া ও চারায় মড়ক রোগের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। দেশে প্রতিবছর কমবেশি ২০ শতাংশ পাট বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়। ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল ও চীনেও পাটের নানা ধরনের রোগের আক্রমণ হয়ে থাকে। রোগ সৃষ্টিকারী জিন শনাক্ত করার ফলে রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এ ছাড়া পাটের আঁশ বৃদ্ধি ও লম্বার জন্য দায়ী দুটি জিনও শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব জিন কাজে লাগিয়ে ভালো ও বেশি আঁশযুক্ত পাটের জাত উদ্ভাবন করা যাবে।
ছত্রাকের তিনটি জিন
ম্যাক্রোফমিনা ফেসিওলিনা নামের ছত্রাকের জিনোম তথ্য থেকে পেকটিন, লিগনিন ও সেলুলোজ ভাঙতে পারে এমন এনজাইম উৎপাদনকারী জিন ওই বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন।
এই জিনগুলোর পেটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। ক্ষতিকারক হিসেবে পরিচিত এসব ছত্রাককে উদ্ভিদ, ফসল ও ফলের গুণাগুণ বাড়ানোর জন্য কাজে লাগানো যাবে। এর ফলে যেকোনো উদ্ভিদ বা ফল থেকে দ্রুত রস তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে। জৈব জ্বালানি বা জৈব ইথানল, কাগজ, কসমেটিকস তৈরিতেও ওই এনজাইম কাজে লাগানো যাবে।
ষাটের দশকে দেশে পাটের জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম। পেটেন্ট পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও অর্থনীতির সঙ্গে মিশে আছে পাট। এবার বিশ্বের পাট গবেষণার জৈবপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখল। এই পেটেন্ট কাজে লাগিয়ে শিল্পের উপযোগী পাটপণ্য উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে।