দাম দেখে যায় না বোঝা

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি দুর্বল মৌলভিত্তির ২০টি কোম্পানি। তবে বাজারে গত ছয় মাসে এসব কোম্পানির বেশির ভাগের শেয়ারের দাম বেড়েছে। এমনকি কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে আড়াই গুণেরও বেশি। ফলে শেয়ারের দাম দেখে যায় না বোঝা এসব কোম্পানি কতটা বাজে মানের।

১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি কে অ্যান্ড কিউর কথাই ধরা যাক। গতকাল রোববার দিন শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১১ টাকায়। কোম্পানিটি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মালিকানাধীন।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) নিয়মিত লভ্যাংশ ঘোষণাসহ আরও বেশ কিছু মাপকাঠির ভিত্তিতে ভালো মানের বাছাই করা ৩০ কোম্পানি নিয়ে ডিএস-৩০ নামে আলাদা একটি সূচক করা রয়েছে। সেই সূচকে অন্তর্ভুক্ত ৩০ কোম্পানির মধ্যে ১৮টিরই দাম কে অ্যান্ড কিউ কোম্পানিটির গতকালের বাজারমূল্যের নিচে রয়েছে।

এইটুকুতে কে অ্যান্ড কিউর শেয়ারের দাম দেখে যে কারও মনে হতে পারে নিশ্চয় কোম্পানিটি বেশ ভালো পারফরম্যান্স করছে। সেটি ভাবলে চরম ভুল করবেন। কারণ, বাজারে বাজে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে দাম দেখে ভালোমন্দ যাচাই করা কষ্টসাধ্য।

গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি কে অ্যান্ড কিউ। কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা ভালো না। বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস মাত্র ৫ পয়সা। দীর্ঘদিন ধরে এটি দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত। তা সত্ত্বেও গত ছয় মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম আড়াই গুণেরও বেশি বেড়েছে। চলতি বছরের ৭ মে কে অ্যান্ড কিউর প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ৪৩ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১১১ টাকায়। সেই হিসাবে ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের ১৫৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।

একই মালিকানার অপর কোম্পানি দুলামিয়া কটনেরও প্রায় একই অবস্থা। শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে না পারা এ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছয় মাসে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে বাজারে। গত মে মাসের শুরুতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল প্রায় ৮ টাকা, গতকাল দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ১০ পয়সায়। অর্থাৎ ছয় মাসে ১০০ শতাংশ দাম বেড়েছে এটির।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের মালিকানাধীন ঝিলবাংলা সুগার মিলসের শেয়ারের দামও ছয় মাসে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গত ৭ মে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৩২ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা ২ টাকা ৩০ পয়সা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ টাকা ২০ পয়সায়। তাতে গত ছয় মাসে এটির শেয়ারের দাম প্রায় ৯৪ শতাংশ বেড়েছে।

গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি ঝিলবাংলা। বছর শেষে কোম্পানিটির ইপিএস ৫৪ টাকারও বেশি ঋণাত্মক। অর্থাৎ বছর শেষে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটিকে ৫৪ টাকা করে লোকসান গুনতে হয়েছে। কিন্তু শেয়ারের বাজারমূল্য দেখে কোম্পানিটির এত খারাপ আর্থিক অবস্থার ধারণা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়মিত লভ্যাংশ দিয়ে এবং ইপিএসের দিক থেকে এগিয়ে থেকেও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তিতাস গ্যাসের শেয়ার গতকালের বাজারে ৪৭ টাকায় হাতবদল হয়েছে। সেখানে ঝিলবাংলার শেয়ারের দাম তিতাসের দামের চেয়ে প্রায় ১৫ টাকা বেশি।

বাজে এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘এসব শেয়ার যাঁরা কেনেন তাঁরা মূলত জুয়াড়ি। নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে তারা খোঁজখবর না নিয়ে এসব শেয়ার কেনেন। এ সুযোগে কোম্পানিগুলোর পরিচালকেরাও নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়ান-কমান। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমার পরামর্শ, বাজে কোম্পানির শেয়ারকে গুরুত্ব না দেওয়া।’

দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত অপর কোম্পানি জুট স্পিনার্সের শেয়ারের দাম ছয় মাসে ২৭ টাকা বেড়ে গতকাল দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৭৮ টাকা ২০ পয়সায়। এ কোম্পানিটিও গত জুনের আর্থিক বছর শেষে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় প্রায় ৪৯ টাকা ঋণাত্মক। শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকায় গত জুলাইয়ে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে শেয়ারধারীদের সতর্ক করা হয়। সেই সতর্কবার্তায় বলা হয়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে কোম্পানির সব ধরনের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, যা এখনো চালু হয়নি। তা সত্ত্বেও বন্ধ কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।

শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারায় তালিকাভুক্তির নিয়ম অনুযায়ী, গত ৩০ অক্টোবর স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজকে ‘এ’ শ্রেণি থেকে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। তাতে করে কোম্পানিটির শেয়ার কেনাবেচায় বন্ধ হয়ে যায় ঋণসুবিধা। বছর শেষে কোম্পানিটির ইপিএসও ৩৯ পয়সা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। অথচ এটির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি থামছে না। গতকালও কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ৩ টাকা বা সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ টাকায়। গত মে মাসেও এটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৫৭ টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার অবনতি সত্ত্বেও ছয় মাসে শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা।

এর বাইরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে না পারা যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম গত ছয় মাসে বেড়েছে তার মধ্যে রয়েছে শ্যামপুর সুগার, ইমাম বাটন, শাইনপুকুর সিরামিকস, মেঘনা কনডেনসেড, মেঘনা পিইটি, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, সমতা লেদার, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, বিচ হ্যাচারি ও সাভার রিফ্যাক্টরিজ। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি ঠিকমতো উৎপাদন কার্যক্রমেও নেই। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব কোম্পানির বেশির ভাগই স্বল্প মূলধনি কোম্পানি। বাজারে এদের শেয়ার সংখ্যা কম। তাই এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ।

এ ছাড়া লভ্যাংশ ঘোষণা করতে না পারা ২০ কোম্পানির মধ্যে তিনটির দাম গত ছয় মাসে কমেছে। কোম্পানি তিনটি হলো আরামিট সিমেন্ট, বেক্সিমকো সিনথেটিকস ও হাক্কানি পাল্প।

মূল্যবৃদ্ধির ৬ মাসের চিত্র

কোম্পানি               ছয় মাস         গতকালের     বেড়েছে

আগের দাম      দাম

ঝিলবাংলা সুগার         ৩২              ৬২           ৯৪ %

শ্যামপুর সুগার          ২২              ২৮           ২৭%

কে অ্যান্ড কিউ          ৪৩              ১১১           ১৫৭%

জুট স্পিনার্স             ৫১              ৭৮           ৫৩%

দুলামিয়া কটন           ৮               ১৬            ১০০%

ইমাম বাটন             ১৩              ২৭            ১০৮%

শাইনপুকুর              ১১              ১৫            ৩৬%

সমতা লেদার           ২৭              ৪৫           ৬৭%

স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস      ৫৭              ৮৭           ৫৩%

সাভার রিফ্যাক্টরিজ       ৬৯              ১০২          ৪৮%

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ