সাহস করে মামলা পর বেরোল কঠিন সত্য
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ছুটির দিনে তিন বান্ধবীকে নিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যান এক পোশাককর্মী। সন্ধ্যার পর বাসে করে তাঁরা ফিরছিলেন। পতেঙ্গা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শহরের বহদ্দারহাট এলাকায় অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তাঁর তিন বান্ধবীও বাস থেকে নেমে যান। রাত তখন সাড়ে আটটা। বাসে একা ওই তরুণী। তিনি যাবেন আরও দুই কিলোমিটার দূরে চান্দগাঁওয়ের মৌলভীপুকুর পাড় এলাকায়। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।
বহদ্দারহাটে যাত্রী নামিয়ে বাসটি আবার চলা শুরু করার পরই চালকের সহকারী সব জানালা বন্ধ করে দরজাও আটকে দেন। রাস্তায় তখন স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে অন্য গাড়ি। হঠাৎ ছোরা নিয়ে এসে বাসের একমাত্র যাত্রী ওই তরুণীকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেন চালকের সহকারী। এরপর ওই সহকারী চালকের আসনে বসেন। আর চালক উঠে এসে ধর্ষণ করেন তরুণীকে। গত ২৭ অক্টোবর এ ঘটনা ঘটলেও এত দিন তা অজানা ছিল সবার।
ঘটনার পর সাত দিন চুপচাপ ছিলেন ওই তরুণী। পরে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানায় সাহস করে দুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন তিনি। পরদিন ওই বাসের চালক রাশেদুল ইসলাম (২০) ও সহকারী ইমতিয়াজ উদ্দিনকে (১৮) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুজনকে শনাক্ত করেন ওই তরুণী। ৪ নভেম্বর অপরাধ স্বীকার করে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নাজমুল হোসেন চৌধুরীর আদালতে জবানবন্দি দেন বাসচালক ও সহকারী।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এক গৃহবধূকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়। এ ছাড়া গত ২৫ আগস্ট টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন বাসচালক, সহকারীসহ পাঁচ পরিবহনশ্রমিক।
এর আগে ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের দিল্লিতে চলন্ত বাসে নির্ভয়া (ছদ্মনাম) নামের এক ছাত্রী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে চলন্ত একটি বাসে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাসচালক ও চালকের সহকারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দেন বাসচালক ও চালকের সহকারী। ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে একটি বাসে দুই বোনকে ধর্ষণ করেন পাঁচ পরিবহনকর্মী। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে চালকসহ তিন পরিবহনকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
চলন্ত বাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের এসব ঘটনায় গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অসহায় নারীদের বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া চট্টগ্রামের মানবাধিকারকর্মী তুতুল বাহার বলেন, পৈশাচিক এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি গাড়িতে চালক ও সহকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে। নারীরা রাস্তায় এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। হাজারো কর্মজীবী নারী রাতে বাসায় ফেরেন। রাস্তায়, যানবাহনে তাঁরা যাতে নিরাপদ বোধ করেন সে পরিবেশ সৃষ্টিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে।
ধর্ষণের শিকার চট্টগ্রামের ওই তরুণী গতকাল রোববার বলেন, তিনি শহরের কালুরঘাট এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ঘটনার পর তিনি ভয়ে ছিলেন। এ জন্য বাসা থেকে বের হননি। শহরে তিনি বড় বোনের বাসায় থাকেন। পরে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাসার বলেন, চালক ও সহকারীর চেহারা সম্পর্কে ওই তরুণীর কাছ থেকে কিছুটা ধারণা নিয়ে তাঁরা অভিযান শুরু করেন। গত শনিবার বহদ্দারহাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পর দুজনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। পরে তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন।
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের অতিরিক্ত মহাসচিব গোলাম রসুল গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, বাসে কোনো যাত্রী ধর্ষণের শিকার হলে চালক ও সহকারীকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ ধরনের অপরাধীদের কোনো সহযোগিতা দেবে না সংগঠন। এমনকি তাঁরা জামিনে বেরিয়ে এলেও বাসে কাজ করতে দেওয়া হবে না।
এদিকে ঘটনার পর থেকে ওই তরুণী পোশাক কারখানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান তাঁর বড় বোনের স্বামী। তিনি বলেন, দুই ধর্ষকের ফাঁসি চান তাঁরা। যাতে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন জঘন্য কাজ করার সাহস কেউ না পায়।