নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি বড় অগ্রগতি
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ দফায় কোনো প্রস্তাব নেওয়া যায়নি। গত সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে সভাপতির বিবৃতি। দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার সম্মতি না পাওয়ায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব নিতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব নেওয়া না হলেও পরিষদে সভাপতির বিবৃতিকে ইতিবাচক মনে করছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক বলেন, জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার পর সর্বসম্মতভাবে সভাপতির বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। প্রায় আড়াই মাস ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, এটিকে তার ‘বড় অগ্রগতি’ হিসেবে দেখা উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের প্রতিবাদে আগামী দুই সপ্তাহে ঢাকা, নেপিডো ও নিউইয়র্কে বড় পরিসরে আলোচনা হতে যাচ্ছে। এ মাসের ২০ ও ২১ তারিখ মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে অন্তত চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। তাঁদের মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ১৮ নভেম্বর এবং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো ১৯ নভেম্বর ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশ ঘুরে তাঁরা সবাই যাবেন মিয়ানমারে। তাঁদের সফরের পর কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মারি ক্লদ বিবু ২১ তারিখ আসবেন বাংলাদেশে। ফলে এসব সফর ও বৈঠককে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে বাংলাদেশ।
এদিকে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির এক প্রতিনিধিদলের ১৮ নভেম্বর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসে শুরুতেই কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখবে। এরপর ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নিতে ২ নভেম্বর মার্কিন সিনেটে খসড়া উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রস্তাবিত সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। কারণ রিপাবলিকান সিনেটের জন ম্যাককেইনকে নিয়ে যৌথভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ও ডেমোক্র্যাট সিনেটর বেন কারডিন। তিনি এ বিষয়ে বলেছেন, প্রস্তাবটি বিল আকারে পাস হলে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতকে শক্তিশালী করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আজ বুধবার রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের চার প্রতিবেশী দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করবেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠেয় এই ব্রিফিংয়ে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংচিয়াং, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত পানপিমন সুয়ানাপোংসে এবং লাউসের অনাবাসী রাষ্ট্রদূত সুথাম সাকুননিনহম অংশ নেবেন।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে জাতিসংঘের সামাজিক, মানবিক ও মানবাধিকারবিষয়ক ফোরাম থার্ড কমিটিতে দেওয়া প্রস্তাবে অধিকাংশ দেশের সমর্থন পাওয়াটা বাংলাদেশের সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে জাতিসংঘ মহাসচিবের একজন বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির বিবৃতিতেও আছে একই প্রস্তাব। তবে চীন ও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ এ রকম আলাদা ম্যান্ডেটকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বিবেচনায় নিয়ে এখন পর্যন্ত আপত্তি করে যাচ্ছে। ১৪ নভেম্বর ভোটাভুটির মাধ্যমে থার্ড কমিটির প্রস্তাবটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল দুপুরে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বেইজিং যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আসেম সফরের আগে বাংলাদেশে আসার কথা জানান।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, কোনো দেশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পরিষদের বিবৃতি, সভাপতির বিবৃতি ও প্রস্তাব গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনার পর মিয়ানমার নিয়ে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে সভাপতির বিবৃতিটি গ্রহণ করা হয়েছে। ভিন্নমত থাকলেও নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের সবাই রাজি হওয়ায় বিবৃতিটি গৃহীত হয়েছে। ফলে এটিকে কিছুই না হওয়া বা দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই। এর আগে সেপ্টেম্বরে সাধারণ পরিষদ একটি বিবৃতি দিয়েছিল মিয়ানমার নিয়ে।
গত ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতন-পরবর্তী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সদিচ্ছার ঘাটতি প্রশ্নহীন নয়। এরপরও দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসা, আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের আবার রাখাইনে যেতে দেওয়ার মতো কাজগুলো করছে আন্তর্জাতিক চাপে। এই চাপ সরে গেলে মিয়ানমার আগের মতোই সময় নষ্ট করার পথে যেতে পারে। তাই ধাপে ধাপে মিয়ানমারের ওপর চাপটা রাখার কোনো বিকল্প নেই। এদিক থেকে দেখলে নিরাপত্তা পরিষদে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব গৃহীত হলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রস্তাব নেওয়ার পর তা মানা কিংবা না মানা দেশটির ওপর নির্ভর করে। কারণ অতীতেও এ ধরনের প্রস্তাবে খুব একটা তোয়াক্কা করেনি মিয়ানমার। এর পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হলে চীনের মতো যারা এখনো মিয়ানমারের পক্ষে আছে, তাদের কাছে অনুরোধের পথও বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই বিবেচনায় ধাপে ধাপে মিয়ানমারকে চাপে রাখাই ভালো বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
নিউইয়র্কে কর্মরত বাংলাদেশি কূটনীতিকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ আরও অর্থপূর্ণ ও প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা নেবে, বাংলাদেশের এই আশা হয়তো পূরণ হয়নি। তবে পরিষদ সভাপতির জোরালো বক্তব্যে তাদের উৎসাহিত করছে। পরিষদ যাতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করে সে জন্য গত কয়েক সপ্তাহ পরিষদের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা সলাপরামর্শ চালিয়ে গেছেন। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য একটি খসড়া প্রস্তাব বিলি করার পর এ ব্যাপারে তাঁরা বিশেষভাবে উৎসাহিত হন। তবে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে কোনো প্রস্তাব গ্রহণে রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়া যায়নি। চীন যুক্তি দেখায়, রাখাইন রাজ্যে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, এই অবস্থায় মিয়ানমারকে দোষারোপ করে পরিষদের প্রস্তাব সহায়ক হবে না। রাশিয়া ‘ছোট ছোট পদক্ষেপ’ গ্রহণের মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রস্তাব রাখে। তারা উভয়েই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমারের অধিকার রয়েছে, এমন যুক্তি দেখায়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর গত সোমবার দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে তাঁর দেশ। এই বৈঠকের বিষয় ছিল ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি’। বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুর ওপর নজর রাখছে এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি মূল্যায়ন করছে।