দ্বিপক্ষীয় মোড়ক দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা মিয়ানমারের
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের কথা বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে মিয়ানমার। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের এই সমস্যায় দ্বিপক্ষীয় মোড়ক দিয়ে মিয়ানমার আবারও অতীতের মতো নষ্ট করছে।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির সর্বসম্মত বিবৃতি নিয়ে মিয়ানমারের প্রতিবাদ বিশ্লেষণ করলে এই ধারণা পাওয়া যায়।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তর গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মিয়ানমার বলছে, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি দুই দেশের আলোচনাকে ‘মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত’ করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে ১৬-১৮ নভেম্বর মিয়ানমার সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এর সবশেষ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী চার দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নভেম্বরের ৫ তারিখ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির বিবৃতির প্রসঙ্গে টেনে মাহমুদ আলী সমস্যার টেকসই সমাধানে চার দেশের সহযোগিতা ও সমর্থন চান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিস্থিতি নিয়েও চার দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মাহমুদ আলী তাঁদের জানান, মিয়ানমারের প্রত্যাশা অনুযায়ী আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের আগে এ মাসের ১৬ ও ১৭ তারিখ তাঁর পক্ষে নেপিডো যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ওই সময়ে চীন, জাপান, জার্মানি ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বাংলাদেশে আসছেন। তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে তিনি আসেম বৈঠকের পর ২২ ও ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য নেপিডো থাকতে আগ্রহী।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠেয় এই ব্রিফিংয়ে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংচিয়াং, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত পানপিমন সুয়ানাপোংসে এবং লাউসের অনাবাসী রাষ্ট্রদূত সুথাম সাকুননিনহম অংশ নেন।
‘সমস্যাটা শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়’
গত সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে পরিষদ রাজ্যটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ওই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার বলছে, এটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের আলোচনাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। মিয়ানমারের মতে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ যে সমস্যা মোকাবিলা করছে, তা দুই দেশের মধ্যে কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।
সু চির দপ্তর থেকে দেওয়া ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অধিকন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির এই বিবৃতি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে মসৃণ ও দ্রুতগতিতে চলা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটে চীনের ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের কিছু সদস্য দেশের অবস্থানকে অভিনন্দন জানায় মিয়ানমার। কারণ, দেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিকে সমুন্নত রেখেছে।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের এই বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বিপক্ষীয়—ঘুরেফিরে এটিই বলার চেষ্টা করছে দেশটি। তাই নিরাপত্তা পরিষদের এখানে জড়ানো ঠিক হচ্ছে না এমন মত দিচ্ছে মিয়ানমার।
প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যাটা যদি দ্বিপক্ষীয় হয়ে থাকে, তবে ১৯৭৮ সালের পর ১৯৯২ সালে সমস্যা সমাধান শেষে তা টেকসই হয়নি। ২০১২ সালের পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং সবার শেষে এ বছরের ২৫ আগস্টের পরও অন্তত ৬ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার, রোহিঙ্গারা যতক্ষণ বাংলাদেশে থাকছে, সে সময় পর্যন্ত বিষয়টিতে দ্বিপক্ষীয় উপাদান থাকছে। তবে কোনো দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে দেশটির নাগরিকেরা ব্যাপকভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শিকার হলে তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিতে হয়। আবার বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে তাদের ভালোভাবে দেখেশুনে রাখাটা সে দেশেরই দায়িত্ব। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু দ্বিপক্ষীয়, এটা বলার সুযোগ নেই। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মাত্রা রয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্যে এ মাসেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরে মিয়ানমার যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন থেকে যায়। ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ১১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এ দফায় সমস্যা শুরুর প্রায় আড়াই মাস পর এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক চাপ সরলে মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত কিছুই করবে না। এই অবস্থায় জাতিসংঘের সামাজিক, মানবিক ও মানবাধিকার বিষয়ক ফোরাম থার্ড কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হতে যাচ্ছে। নেপিডোতে আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকেও বিষয়টি তোলার কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ মাসের শেষে ও আগামী মাসের শুরুতে পোপ দ্বিতীয় জন পল মিয়ানমার ঘুরে বাংলাদেশে আসবেন। এসব বৈঠক ও সফরে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আলোচনার পর মিয়ানমারের ওপর যে চাপ বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। ফলে মিয়ানমারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরটি ডিসেম্বরে হলে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও জোরালো অবস্থানে থাকত বলে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
মিয়ানমারে পেট্রোনাসের কাজ বন্ধের আহ্বান মালয়েশীয় সাংসদদের
রয়টার্স জানায়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি সংস্থা পেট্রোনাসকে কার্যক্রম এবং বিনিয়োগ গুটিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্যরা।
মালয়েশিয়ার ৪০ জনের বেশি পার্লামেন্ট সদস্য গতকাল বুধবার একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন।