১০০ তাঁবু নিয়ে যে হাসপাতাল

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সারি সারি সাদা তাঁবু। কোনোটি ছোট, কোনোটি বড়। এ রকম ১০০টি তাঁবু নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি হাসপাতাল। এর মধ্যে দুটি তাঁবু ব্যবহার করা হচ্ছে অস্ত্রোপচারকক্ষ হিসেবে। রোগনির্ণয়ের জন্য দুটি তাঁবু নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ল্যাব (পরীক্ষাগার)। এমনকি এক শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও (আইসিইউ) রয়েছে তাঁবুতে। এর মধ্যে অস্ত্রোপচারকক্ষ, পরীক্ষাগার ও আইসিইউ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। তাঁবু দিয়ে বানানো এই হাসপাতালে রোগীদের জন্য মোট শয্যা রয়েছে ৬০টি।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দিতে এই হাসপাতালটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। নাম বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট ফিল্ড হাসপাতাল। এটি পরিচালনায় সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠান রেডক্রস। কক্সবাজারের উখিয়ায় টেলিভিশন উপকেন্দ্রের কাছে একটি টিলার ওপর এই হাসপাতালের অবস্থান। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির থেকে এই হাসপাতালের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার।

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে যুক্ত রেড ক্রিসেন্টের প্রকল্প পরিচালক ইকরাম এলাহী চৌধুরী বলেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়। হাসপাতালটি চলতি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৮ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে চিকিৎসা দিয়েছে। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ২৬টি। প্রসব হয়েছে ১৩টি। এখন দিনে অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে গড়ে ৩০ জন। বহির্বিভাগের সেবা নেয় গড়ে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা। এখানে সার্বক্ষণিক দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকে। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে রয়েছে ব্লাড ব্যাংকও।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে ওষুধও দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিন বেলা খাবার দেওয়া হয় ভর্তি হওয়া রোগীদের। সার্বক্ষণিক চিকিৎসার জন্য রয়েছেন বাংলাদেশি ১৫ চিকিৎসক। এ ছাড়া বিদেশি আরও ৭ জন চিকিৎসকও দায়িত্ব পালন করেন। ১০ জন নার্স ও ৩০ জন মিডওয়াইফারি স্টাফ (মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী) এখানে কাজ করেন। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে দেশি চিকিৎসকদের এই হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা দিতে নির্মিত এ হাসপাতালটি গত ২৬ অক্টোবর পরিদর্শন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (আইএফআরসি) মহাসচিব এল হাজি এমাদু গেই সি।

২৬ অক্টোবর দেখা যায়, একটি বড় তাঁবুর (দৈর্ঘ্যে ২০ ফুট, প্রস্থেও ২০ ফুট) ভেতরে বহির্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বড় আরও তিনটি তাঁবুতে রয়েছে অন্তর্বিভাগের শয্যা। এক-একটি তাঁবুতে কমপক্ষে ছয়টি শয্যা। ১০০টি তাঁবুর মধ্যে অর্ধেক ব্যবহার হচ্ছে হাসপাতালের রোগীদের সেবায়। বাকি তাঁবুতে থাকেন চিকিৎসক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রয়েছে জেনারেটর। এ ছাড়া পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে তা অস্থায়ী শৌচাগার, অস্ত্রোপচারকক্ষসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরবরাহ করা হয়।

রোগী ছাড়া সাধারণ দর্শনার্থীদের এই হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয় না। পেটে ব্যথা নিয়ে ২৬ অক্টোবর দুপুরে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন রোহিঙ্গা মো. হাশেম। সেবা নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানান তিনি।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত সেবা নেওয়া রোগীদের বেশির ভাগ জ্বর, ডায়রিয়া, হাড়ভাঙা, প্রসূতি, অ্যাপেন্ডিসাইটিস ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ছিল। এর মধ্যে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত তিনজন রোগীর ছোট অস্ত্রোপচার সফলভাবে করেছেন চিকিৎসকেরা। তিনজনের অ্যাপেন্ডিসাইটিস অস্ত্রোপচার এবং সাতজন নারী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন এই হাসপাতালে।

হাসপাতালে কর্তব্যরত হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক (সার্জন) মো. শামীম বলেন, মাঝারি ধরনের অস্ত্রোপচার হয় এখানে।

মূলত নরওয়ে রেডক্রসের সহযোগিতায় এই অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে বলে জানান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পরই বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবার জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে এত বড় অস্থায়ী হাসপাতাল আর নেই। এটি মানবতার জন্য অনন্য এক উদ্যোগ।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ