রাশিয়ার আকাশে নতুন চমক আসছে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আকাশপথে রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলোর দুর্দান্ত দাপটের কথা কে না জানে? পুতিনের হাত ধরে দেশটির সমরশক্তি আকাশপথকে আরও সুসংহত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আসছে রাশিয়ার কৌশলগত নতুন যুদ্ধবিমান টু-১৬০। এটি অনেক আগে থেকেই পশ্চিমাদের জন্য মাথাব্যথা হয়ে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সুপারসনিক যুদ্ধবিমানকে এবার আরও আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রেমলিন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ওড়াতে যাচ্ছে টুপোলেভ টু-১৬০এম২।
নতুন যুদ্ধবিমানে আধুনিক ও সবচেয়ে শক্তিশালী ০২ সিরিজের কুজনেৎসভ এন কে -৩২ টার্বোফ্যান ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে, যা আরও বেশি কার্যক্ষম। এই ইঞ্জিনকে যুদ্ধবিমানের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হয়। আগের মডেলের ইঞ্জিন থেকে এটি আরও বেশি নির্রভযোগ্য। অতিরিক্ত দূরত্বের গন্তব্যে গেলে ওড়া অবস্থায় অন্য বিমান থেকে জ্বালানি নেওয়ার ব্যবস্থা (ইন ফ্লাইট রিফুয়েলিং) থাকছে টু-১৬০-এ। সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার ১৩০ টন জ্বালানি তেল দিয়ে অন্তত ১৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে, টু-১৬০এম২ বিমানে আগের মডেলের মতো কেএইচ-১০১/১০২ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে। রাশিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আঘাত হানতে পারে। নয়া ক্ষেপণাস্ত্র কেএইচ ১০১-কে রাশিয়ায় তো বটেই, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘপাল্লার উন্নত প্রযুক্তির বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বলে ধরা হয়। সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায় এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি টু-১৬০এম২ বিমান ৪০ হাজারেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ান কনকর্ড নামে পরিচিত টু-১৬০-এর মতো দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারা টু-১৬০এম২ যুদ্ধ বিমানও বিশ্বে সবচেয়ে বড় ও ভারী যুদ্ধবিমান হতে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দ্রুতগতির যুদ্ধবিমান হিসেবেও এটি বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে। ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার গতিতে বিমানটি ওড়ানোর জন্য কমপক্ষে চারজন ক্রু প্রয়োজন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপারসনিক যুদ্ধবিমানে নতুন আর কী থাকছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানানো হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের নামকরা বিমান নকশাকার আন্দ্রেই টুপোলেভের গড়া টুপোলেভ বিমান ডিজাইন কোম্পানি আশির দশকে টু-১৬০ বিমানের নকশা তৈরির কাজ করে। ১৯৮১ সালের ১৯ ডিসেম্বর টু-১৬০ বিমান সর্বপ্রথম আকাশে ওড়ে। শুরুর দিকে এ মডেলের ৩৫টি বিমান নির্মাণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৮টি প্রটোটাইপস ও ২৭টি সিরিয়াল মডেলের এয়ারক্রাফট ছিল। এই যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঘণ্টায় ৯৬০ কিলোমিটার বেগে গিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত হানতে পারে। প্রচলিত বোমা ছাড়াও পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম টু-১৬০ রাশিয়ার কৌশলগত পরমাণু বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর বিমানবহরে থাকা সে দেশের অন্যতম কৌশলগত ভারী যুদ্ধবিমান বি-২ স্পিরিট ও বি-১বি যুদ্ধবিমানের সঙ্গে প্রায়ই তুলনা করা হয় রাশিয়ার টু-১৬০ বিমানের। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের কাছে টু-১৬০এম২ মডেলের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এখন পর্যন্ত নেই।
মার্কিন সাময়িকী ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’-এর প্রতিরক্ষাবিষয়ক সম্পাদক দাভে মাজুমদারের মতে, দুই বিমানের বাহ্যিক কাঠামো দেখতে কিছুটা এক মনে হলেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে দুটি বিমানের নির্মাণশৈলী আলাদা। আকার ও গতির দিক দিয়েও বি-১বি থেকে টু-১৬০ এগিয়ে রয়েছে। তবে উঁচু আকাশে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এই দুটি বিমান সমান কার্যক্ষম।
কসোভো, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল মার্কিন বি-১বি বিমান। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে আকাশপথে অভিযান চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বি-১বি বিমান ব্যবহার করছে। ২০১৫ সাল থেকে সিরিয়ায় একই অভিযান চালাতে রাশিয়া ব্যবহার করছে টু-১৬০, টু-৯৫ ও টু-২২এম মডেলের দূরপাল্লার যুদ্ধবিমান।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও স্পেনের বিমানবাহিনীর বহরে থাকা শক্তিশালী ইউরোফাইটার টাইফুন মডেলের বোমারু বিমানগুলো বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে রাশিয়ার টু-১৬০ বিমানের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। টাইফুন বিমান একটানা মাত্র ২ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটার পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারে। আবার ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথভাবে তৈরি জাগুয়ার এয়ারক্রাফটও গতির দিক দিয়ে ( ঘণ্টায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার) টু-১৬০ বিমানের অনেক পেছনে রয়েছে।
মার্কিন সাময়িকী ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে রুশ বিমানবাহিনীর বহরে টু-১৬০ সিরিজের ১৬টি বিমান রয়েছে, যার সব কটি তৈরি করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। এর মধ্যে অন্তত ৮ থেকে ১০টি বিমান বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। দুই ধাপে করা এ সংস্কারকাজে রুশ বিমানবাহিনীকে প্রায় ১০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে। রাশিয়া ছাড়াও ইউক্রেনের বিমানবাহিনীতে টু-১৬০ সিরিজের বিমান রয়েছে।
টু-১৬০ মডেলের আধুনিকীকরণকে রাশিয়ার প্রাথমিক যুদ্ধবিমানের প্রথম আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন নেভাল অ্যানালাইসিস সেন্টারের রুশ সামরিকবিষয়ক গবেষক মিখায়েল কফম্যান। ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রুশ সরকার নিঃসন্দেহে এটিকে ছোট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে না। কারণ, এখানে মূল বিমানের নির্মাণপ্রক্রিয়া পুনরায় পর্যালোচনা করা ছাড়াও একটি নতুন উৎপাদন কর্মপ্রণালি ঠিক করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি।
পশ্চিমা দেশগুলোর বেঁধে দেওয়া চলমান নিষেধাজ্ঞা, রুবলের দরপতন ও অর্থনৈতিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও পুতিন সরকার রাশিয়ার সামরিক খাতকে বরাবরই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে দেশটির কৌশলগত টু-১৬০ মডেলের যুদ্ধবিমানের আধুনিক সংস্করণ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৮-২৫ সাল পর্যন্ত সে দেশে যে রাষ্ট্রীয় রণকৌশল প্রকল্প (জিপিভি) শুরু হতে যাচ্ছে, সেখানে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে টু-১৬০এম২ প্রকল্পটি। এর মধ্যে পুতিনের কাছে এ নিয়ে একটি খসড়া পাঠানো হয়েছে।
১৬ নভেম্বর কাজানের এয়ারক্রাফট এন্টারপ্রাইজের হ্যাঙ্গার থেকে নবনির্মিত টু-১৬০এম২ বিমান গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই প্রথমবারের মতো টু-১৬০ বিমানের নতুন সংস্করণ বানাল আধুনিক রাশিয়া।
এক নজরে টু-১৬০এম২
দেশ: রাশিয়া
বহির্বিশ্বে পরিচিতি: ব্লাকজ্যাক নামে
প্রথম ক্রেতা: রুশ বিমানবাহিনী
নির্মাণ প্রতিষ্ঠান: কাজান এয়ারক্রাফট এন্টারপ্রাইজ
ডিজাইন: টুপোলেভ বিমান ডিজাইন কোম্পানি
বিশেষত্ব: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুপারসনিক যুদ্ধবিমান
ইঞ্জিন: কুজনেৎসভ এন কে -৩২ টার্বোফ্যান
একটানা উড়তে পারবে: ১৩০ টন জ্বালানি তেল দিয়ে অন্তত ১৫ ঘণ্টা
টু-১৬০এম২-এর প্রথম উড্ডয়ন হবে: ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
বাণিজ্যিকভাবে হস্তান্তর শুরু হবে: ২০২৩ সালে
আধুনিকীকরণ শেষে যা থাকছে: নতুন ইঞ্জিন, ইলেকট্রনিক অবকাঠামো, কাচের ককপিট, যোগাযোগ ও উন্নত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা