পেরেক ঠুকে প্রচারবোর্ড
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গাছেরও প্রাণ আছে, প্রমাণ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু; বাংলাদেশেই জন্ম নেওয়া প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। তবে সেই প্রাণের দাম দেয় কজন? অক্সিজেনের উৎস গাছপালা নির্বিচারে নিধন নতুন কিছু নয়। তবে যশোরের কেশবপুরে পেরেক ঠুকে প্রচারবোর্ড লাগিয়ে তিলে তিলে যেভাবে গাছ হত্যা চলছে, তা বিবেকবান যে কারও মনে নাড়া দেয়।
এমনই একজন কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফটকের পাশের ওষুধ ব্যবসায়ী কবির হোসেন। সেখানে একটি মরা কৃষ্ণচূড়াগাছ দেখিয়ে বললেন, ‘হাসপাতাল ফটকের সৌন্দর্য ছিল গাছটি। যখন ফুল ফুটত, অন্য রকম একটা আবহ সৃষ্টি হতো। পেরেক ঠুকে প্রচারবোর্ড সেঁটে গাছটি মেরে ফেলা হয়েছে। এখন অন্য কৃষ্ণচূড়াগাছে যখন ফুল ফোটে, আমার হৃদয়টা ডুকরে ওঠে।’
শুকিয়ে যাওয়া গাছটির বুকে এখনো দুটি প্রচারবোর্ড লেপ্টে আছে। একই স্থানে রয়েছে একটি শিল-কড়ইগাছ। সেটি কবির হোসেনেরই লাগানো। কৃষ্ণচূড়াগাছটা মারা যাওয়ার পর তিনি কড়ইগাছটিতে আর প্রচারবোর্ড লাগাতে দেন না। এ নিয়ে অনেকের সঙ্গে তাঁর গোলযোগও হয়েছে।
৭, ৮ ও ৯ নভেম্বর কেশবপুর শহরের ছয়টি সড়ক ঘুরে এমন অন্তত ৫১টি গাছ পাওয়া যায়, যাতে টিন ও কাঠের তৈরি ১১৯টি প্রচারবোর্ড পেরেক ঠুকে লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রচারবোর্ডই বেশি। বাদ যায়নি বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমার প্রচারবোর্ডও।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এগিয়ে আছেন কেশবপুর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ। তাঁর ৪৪টি প্রচারবোর্ড গাছে পেরেক ঠুকে লাগানো হয়েছে।
জানতে চাইলে আবদুল লতিফ বলেন, ‘গাছে মন্ত্রী-মিনিস্টার, মহাসচিব থেকে শুরু করে সবাই পোস্টার, প্রচারপত্র লাগান। তাই আমিও লাগিয়েছি।’ এভাবে প্রচারপত্র লাগানোর বিষয়টি বেঠিক মনে হয় না তাঁর।
জাতীয় পার্টির উপজেলা সভাপতি আইনজীবী আবদুল মজিদের রয়েছে ১৮টি প্রচারবোর্ড। এ ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীশেখ রফিকের তিনটি, পৌরসভার কাউন্সিলর জামাল উদ্দীনের চারটি, পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামের রয়েছে দুটি।
পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মেয়র হওয়ার পরে রাস্তার পাশে অনেক গাছ লাগিয়েছি। দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগানও করেছি। আমি গাছে পেরেক ঠুকে প্রচারে বিশ্বাসী নই। আমার অতি উৎসাহী কোনো কর্মী যদি গাছে প্রচারবোর্ড লাগিয়ে থাকে, তাহলে আমি নিজ উদ্যোগে নামিয়ে দেব। শুধু তা-ই নয়, গাছের গায়ে লাগানো অন্যান্য পোস্টার, প্রচারপত্রও অপসারণ করা হবে।’
এর বাইরে কলিকাতা হারবাল, ডা. মেসবাউর রহমান টেকনিক্যাল কলেজ, পাহাড়ি বনাজি ঔষধালয়, হোপ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইসলামী ব্যাংক, সূচনা প্রি-ক্যাডেট, আল-আমিন মডেল একাডেমিসহ নানা প্রতিষ্ঠানের প্রচারবোর্ড ও প্ল্যাকার্ড দেখতে পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বেশি আছে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের বিজয়স্তম্ভ থেকে মাইকেল গেট পর্যন্ত। এ ছাড়া শহরের ত্রিমোহিনী মোড় থেকে হাসপাতাল মোড়, ত্রিমোহিনী মোড় থেকে কেশবপুর পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ মোড়, বিজয় সেনের মোড় থেকে ধানহাটা, কালীবাড়ি থেকে পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং থানা মোড় থেকে উপজেলা পরিষদ হয়ে বিএডিসি বীজ গুদাম পর্যন্ত বিভিন্ন গাছে পেরেক ঠুকে প্রচারবোর্ড সাঁটানো আছে।
কেশবপুরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা বলেন, গাছে পেরেক ঠুকে কোনো প্ল্যাকার্ড, প্রচারপত্র লাগানো যাবে না। সরকারিভাবে এ-সংক্রান্ত একটি প্রচারপত্র জারি করা আছে। তিনি বলেন, গাছে পেরেক লাগালে জীবনীশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। মাটি থেকে গাছ পানি গ্রহণ করে। তা ছাড়া ছাল দিয়ে পানি বিভিন্ন অংশে যায়। পেরেক ঠুকলে গাছের ওই অংশ পচে গিয়ে গাছ মরে যেতে পারে।
কেশবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি পরিচ্ছন্ন কেশবপুর, সবুজ কেশবপুর কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে গাছের গায়ে লাগানো পোস্টার, প্রচারবোর্ড—সবই অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
কেশবপুর শহরের বিভিন্ন সড়কে গত ২৬ বছরে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন আইনজীবী বদরুজ্জামান। এর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণচূড়া, কামিনী, কাঠবাদাম, বাতাবি লেবু, জাম, কামরাঙা, জলপাই ও আমড়া। দেড় শতাধিক গাছ আজও টিকে আছে। বদরুজ্জামান কেশবপুরে এখন বৃক্ষপ্রেমী হিসেবেপরিচিত। গাছের প্রতি এমন নির্মমতা তাঁকেও কষ্ট দেয়। তিনি বলেন, ‘গাছে পেরেক ঠুকে প্রচারবোর্ড লাগানো খুবই খারাপ কাজ। এতে স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়। তা ছাড়া মানুষের গায়ে পেরেক ঠুকলে যেমন লাগে, গাছেরও তেমন লাগে। তাই এখনই সব গাছ থেকে প্রচারবোর্ড অপসারণ করা উচিত।’