এ মাসেই শীতের আগাম সবজি বাজার দখল
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বৃষ্টির দিনে অনেকেই খিচুড়ি পছন্দ করে। শীতের সবজিও তেমনি পছন্দের। বাজারে গেলেই এখন পাওয়া যাবে সাদা ধবধবে ফুলের নিচে গাঢ় সবুজ পাতার ফুলকপি, সতেজ বাঁধাকপি, সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা শিম, টসটসে কাঁচা টমেটো কিংবা মুলা।
এবার অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত খেতের বিবর্ণ ও অপুষ্ট সবজিকে বিদায় করে এ মাসেই শীতের আগাম সবজি বাজার দখল করেছে। দামও বেশ কিছুটা কমেছে। ফলে একটু সচ্ছল ক্রেতারা ফুলকপি একটির বদলে দুটি, শিম আধা কেজির বদলে এক কেজি কিনতে পারছে।
শিম ও ফুলকপি দিয়ে শোল মাছের তরকারি, বাঁধাকপি ভাজি, কুচে চিংড়ি দিয়ে মুলা অথবা শালগমের ঝোল, কই-ট্যাংরা মাছ দিয়ে লালশাক—এসব পদ এখন রাজধানীবাসীর ঘরে ঘরে। কিন্তু শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালে এখনো শীতের সবজি আসেনি। একটি মাঝারি আকারের ফুলকপি ৪০ টাকা দিয়ে কিনতেই তাদের বাজেটে চাপ পড়ছে।
তবে সবজির বাজার আরও নাগালে আসতে পারত, যদি হাত বদলে দাম বেশি না বাড়ত। ঢাকার কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে খুচরা বাজার ঘুরে সবজি ক্রেতার হাতে পৌঁছাতেই দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতা দীর্ঘদিনের। ফলে আড়তে সবজির দাম যদি পানির দরেও নামে, ঢাকার বাজারে তা একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় থেকে যায়। শীতের মাঝামাঝিতে কৃষকেরা এক কেজি মুলা ২ টাকায় বিক্রি করলেও ঢাকায় তা ২৫ টাকার কমে কিনতে পারে না ক্রেতারা।
এবার বর্ষায় ঢাকায় সবজির দাম অত্যন্ত চড়া ছিল। ৬০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজিই ছিল না। অক্টোবরের শেষ দিকে বাজারে শীতের আগাম সবজির সরবরাহ বাড়তে শুরু করে। দামও কমতে শুরু করে। এখন বাজারে শীতের সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা ছাড়াও পেঁয়াজ পাতা, নতুন আলু ও তাল বেগুন পাওয়া যাচ্ছে। সদ্য এসেছে শালগম।
লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীত মৌসুমে এসব শাকের স্বাদ বেশি হয়। পাওয়া যাচ্ছে সরিষা শাকও। মোটা দাগে এখন বেশির ভাগ সবজির কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। বিক্রেতারা জানান, শীত যত বাড়বে, সবজির দামও কমবে।
আড়ত ছাড়তেই দাম দ্বিগুণ
কারওয়ান বাজার আড়তে বুধবার রাতে সাভার থেকে মুলা নিয়ে এসেছিলেন বাচ্চু মিয়া। কৃষকের কাছ থেকে
খেতসুদ্ধ সবজি কিনে
কিছুদিন পরিচর্যার পরে তিনি তা বাজারে বিক্রি করেন। এ দফায় তিনি এনেছেন প্রায় ৭০ মণ মুলা।
বাচ্চু মিয়া ক্রেতাভেদে প্রতি কেজি মুলার দাম পাচ্ছিলেন ১২ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বনানী কাঁচাবাজারে একই মুলা কেজি প্রতি ৫০ টাকা চান বিক্রেতারা। পশ্চিম আগারগাঁও কাঁচাবাজারে মুলা বিক্রি হয়েছে ৩০-৩৫ টাকা দরে।
কারওয়ান বাজার আড়তে বুধবার রাতে প্রতিটি ফুলকপি সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একই ফুলকপি বনানীতে ৩৫-৪০ টাকা ও আগারগাঁওয়ে ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আড়তের ৩৫-৪০ টাকার শিম ওই দুই খুচরা বাজারেই ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সাভার এলাকা থেকে লালশাক নিয়ে এসেছিলেন জমির হোসেন নামের এক ফড়িয়া ব্যবসায়ী। প্রতি মুটি শাক তিনি ৫-৬ টাকা দরে বিক্রি করেন। বনানী বাজারে একই লালশাক ১৫ টাকা চান বিক্রেতারা। আগারগাঁও বাজারেও একই দাম চাওয়া হয়। কিন্তু দর জিজ্ঞাসা করে হাঁটা দিলেই বিক্রেতার হাঁক, ‘১০ টাকায় নিতে পারেন।’
যারা কারওয়ান বাজারের আশপাশে থাকে, তারা বরং বেশ কম দামে সবজি কিনতে পারে। আড়তের পাশে খোলা আকাশের নিচে সবজির দোকানে বিক্রেতারা বেশ কম দামে বিক্রি করে। আড়তের ভেতরে দিনের বেলা খুচরা সবজি বিক্রি হয়। সেখানে দাম আরও কম। তবে ক্রেতাদের মান দেখে কিনতে হবে।
পরিবারের সাপ্তাহিক বাজার করতে গতকাল বিকেলে কারওয়ান বাজার গিয়েছিলেন ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ইন্দিরা রোডে সবজির দাম অনেক বেশি। কারওয়ান বাজারে প্রতিটি সবজি কেজিতে ১০-২০ টাকা কমে পাওয়া যায়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্দিরা রোডে প্রতি কেজি বরবটির দাম ৮০ টাকা। কারওয়ান বাজার থেকে তা ৬০ টাকায় কিনেছি।’
খুচরা ব্যবসায়ীদের অজুহাত
বনানী বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা আলী আহমেদের চলতি মূলধন ২০ হাজার টাকার মতো। এ টাকা দিয়ে তিনি দৈনিক ৮০০ কেজির মতো সবজি কেনেন। দোকানে তিনজন শ্রমিক, ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ দৈনিক ব্যয় কমপক্ষে ২ হাজার টাকা। এরপর নিজের আয়। এ পুরো ব্যয় তাঁকে ওঠাতে হয় মাত্র ৮০০ কেজি সবজি বিক্রি করে।
আলী আহমেদ বলেন, তিনি ১০ কেজি মুলা কিনেছেন বিক্রির জন্য। এই ১০ কেজিতে ১ কেজি পচা ও পরিমাণে অল্প অল্পকরে বিক্রি করায় ১ কেজি ঘাটতি হবে। মজুরি, দোকান ভাড়া, কর্মীর বেতন ইত্যাদি যোগ করে মুলার দাম ২৫ টাকা দাঁড়াবে। তিনি বলেন, ‘মুলায় একটু বেশি লাভ করছি। কিন্তু পেঁয়াজ ও আলুতে কোনো লাভই হচ্ছে না।’
আগারগাঁও বাজারের খুচরা বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় থাকার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। প্রত্যেক দোকানদারকেই দিনে ৬০০-৭০০ টাকা ঘরে নিয়ে ফিরতে হয়।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, জীবন চালাতে প্রত্যেক বিক্রেতার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় করতে হয়। যেহেতু তাদের দোকান ছোট ও বিক্রি কম, সেহেতু তাদের প্রবণতা হলো কম পরিমাণ পণ্য বেশি দামে বিক্রি করে আয় বেশি করা।
শীতে উৎপাদন বেশি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বর্ষার তুলনায় শীতে সবজির উৎপাদন প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি হয়। বর্ষায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে সবজির খেত ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। শীতে সেটা নেই। বিবিএস এখন পর্যন্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সবজি উৎপাদনের হিসাব চূড়ান্ত করতে পেরেছে। এতে দেখা যায়, ওই বছর দেশে শীতের সবজি উৎপাদিত হয়েছে ২২ লাখ ৩৯ হাজার টন। আর গ্রীষ্মে উৎপাদন ছিল ১৫ লাখ ৮০ হাজার টন।
বিবিএসের হিসাবে, দেশে বছরে ২ লাখ ৬৮ হাজার টন ফুলকপি, ২ লাখ ৯৬ হাজার টন বাঁধাকপি, ১ লাখ ২৯ হাজার টন শিম, ২ লাখ ৮১ হাজার টন শালগম উৎপাদিত হয়। আর লালশাক উৎপাদিত হয়৫২ হাজার টন।