মিয়ানমারের স্বার্থ মেনেই চুক্তি
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাংলাদেশে ২৫ বছর ধরে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গা নয়, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত আসা ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। রাখাইনে ফেরানোর পর শুরুতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়ি বা এর কাছাকাছি নয়, রাখা হবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের ইচ্ছা অনুযায়ী, ’৯২ সালের চুক্তির মতোই এবারের প্রত্যাবাসন চুক্তি সই করেছে দুই দেশ।
গত বৃহস্পতিবার নেপিডোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওই চুক্তি সই করেন।
ফিরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল শনিবার ঢাকায় তাঁর দপ্তরে চুক্তির প্রতিপাদ্য সম্পর্কে যা জানালেন, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা সমুন্নত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ, এ দেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া; অস্থায়ী শিবির নয়, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রত্যাবাসন শেষ করা; রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়ি বা আদিনিবাসের কাছাকাছি কোথাও রাখা ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ জোর দিয়েছিল। কিন্তু সই হওয়া চুক্তিতে এ বিষয়গুলো নেই।
তিন মাস ধরে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার কারণে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীসহ সে দেশের সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েই চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হতে যাচ্ছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়লে চুক্তি করতে বাংলাদেশের তাড়াটাই বেশি মনে হয়েছে।
অবশ্য গতকাল সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন। লিখিত বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি বলেন, এত কিছুর পর, চুক্তির কপি দেওয়ার পর আর কোনো প্রশ্ন থাকে বলে মনে হয় না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ’৯২ সালের চুক্তির ভালো-মন্দ দুই দিক থাকায় সরকার শুরু থেকেই এবারের চুক্তি বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে করার কথা বলে এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন, এবারের পরিস্থিতি ’৯২ সালের চেয়ে আলাদা। এবার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, রোহিঙ্গারা এসেছে বিপুল সংখ্যায়। এবারের চুক্তিতে প্রত্যাবাসন শেষ হওয়ার সময়সীমা নেই কেন জানতে চাইলে মাহমুদ আলী বলেন, ‘শেষ তো দেওয়া যায় না, দিয়ে কোনো লাভও নেই। দেখা যাক, আমরা চেষ্টা করব। গোটা পৃথিবী তো আমাদের সঙ্গে।’
একই বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদ আলী বলেন, ‘এটা ঠিক আছে। ’৯২ সালের চুক্তিই তারা অনুসরণ করতে চায়। মোটামুটি সেভাবেই জিনিসটা করা হয়েছে। তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। এর খুঁটিনাটি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, এটা-ওটা নেই, কেন নেই, কী হবে—এসব কথা বলে তো কোনো লাভ নেই। গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো, রোহিঙ্গাদের তারা ফেরত নিতে চেয়েছে। ফেরত নিতে হবে, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা আমি বলেছি।’
’৯২ সালের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে সেখানকার সমাজে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরানোই ছিল বিবেচ্য। রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের উল্লেখ ছিল না। অবশ্য এবার যে চুক্তি সই হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রসঙ্গটি বেশ কয়েকবার এসেছে।
চুক্তি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট কি না আর জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী চুক্তিটি করা গেছে কি না বা দেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে কি না—এ প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ আলী বলেন, ‘খুবই চমৎকার। আপনার মন্তব্য অত্যন্ত চমৎকার। আমার মনে হয়, হাস্যকর মন্তব্য। আমরা দুই রাষ্ট্র, গোটা বিশ্ব, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গোটা পৃথিবী একদিকে আর আপনি বলছেন এটা কোনো চুক্তিই হয়নি। স্বার্থ উপেক্ষিত। স্বার্থ কে ঠিক করে? যে সরকার ক্ষমতায় আছে সেই সরকার ঠিক করবে। আমরা স্বার্থ ঠিক করেছি। আমাদের স্বার্থ হলো, মূল লক্ষ্য হলো এদের ফেরত পাঠানো। তাদের নিজেদের জায়গায় নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে পাঠানো। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’
মিয়ানমারের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিতে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা বলা হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘(প্রত্যাবাসনের শুরু) দুই মাসের কথা বলা হয়েছে, যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে এসেছে…বেশির ভাগ গ্রাম তো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তারা থাকবে কোথায়? এটা তো সম্ভব নয়। সে জন্য আমি মিয়ানমার যাওয়ার আগেই ভারত ও চীন সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। যেহেতু তাদের প্রি-ফেব্রিকেটেড হাউস (আগে থেকে তৈরি উপকরণ ব্যবহার করে বানানো স্থাপনা) স্থাপনের সক্ষমতা আছে, সে জন্য এটা তারা করতে পারবে কি না সে অনুরোধ করেছিলাম। দুই দেশই তাতে সম্মতি দিয়েছে। মিয়ানমার পক্ষের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনায় তাদের বলেছি, ভারত ও চীন এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে রাজি আছে। মিয়ানমারের মন্ত্রী এতে সম্মত হয়েছেন এবং শিগগিরই এ নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। আমিও ঢাকায় তাদের (ভারত ও চীন) মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করতে বলব।’
রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে অস্থায়ী আবাসন তৈরির দায় মিয়ানমারের হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন ভারত ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করেছে, তার কোনো সদুত্তর কূটনীতিকেরা দিতে পারেননি। জানতে চাইলে একাধিক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, ধরা যাক ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য প্রায় দেড় লাখ বাড়ি তৈরি করতে হবে। বাড়ি তৈরির কাজটা শেষ হতে কত সময় লাগবে? তাহলে কি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাসন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবে?
রোহিঙ্গাদের ফেরানোর চুক্তিটা কেমন হলো জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘রোহিঙ্গা নির্যাতন যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, সে ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এই অবস্থায় আমরা আরও অপেক্ষা করতে পারতাম। আরও দর-কষাকষি করতে পারতাম। তাহলে আমরা ভালো জায়গায় থাকতে পারতাম। কারণ ’৯২ সালের চুক্তির অভিজ্ঞতা মিশ্র। সেবার সফলতা যেমন ছিল, ব্যর্থতাও ছিল। শেষ পর্যন্ত ২২ হাজার শরণার্থীকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়নি। এবার আরেকটু অপেক্ষা করলেই আমাদের জন্য ভালো হতো।’
চুক্তি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনায় যে খসড়াটি তৈরি হয়েছিল, তাতে সময়সীমাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু মাহমুদ আলী ও চ টিন্ট সোয়ের আলোচনায় এগুলো পরিবর্তন করে মিয়ানমারের প্রস্তাবগুলো যুক্ত করে চুক্তি সই হয়। যেমন কর্মকর্তাদের আলোচনায় ২০১৬ সালের আগে থেকে এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এবারের চুক্তি বাস্তবায়নের পর ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটি ছিল না। দুই মন্ত্রীর আলোচনার পর এটি ঠিক হয়। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে বাড়ি বা আদিনিবাসের কাছাকাছি রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের অস্থায়ী একটি জায়গায় রাখার বিষয়টি ঠিক হয় মন্ত্রীদের বৈঠকে। তেমনি পরিচয় যাচাইয়ের দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা কর্মকর্তারা বলেননি। পরে মন্ত্রীরা আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করেছেন। তা ছাড়া রাখাইনে মিয়ানমারের নাগরিকদের নির্যাতনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে, তাদের পরিচয় যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছিল। মন্ত্রীদের আলোচনার পর ‘রাখাইনে মিয়ানমারের নাগরিকদের নির্যাতনের কারণে’ এই শব্দগুলো বাদ গেছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তির মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব একটা শক্ত অবস্থান ছিল। যেখানে সব রোহিঙ্গাকে নেওয়া, ’৯২ সালের চুক্তির অনুসরণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা করা, সময়সীমা ঠিক করা—এ বিষয়গুলো শুরু থেকেই সরকার বলেছে। এখন এমন কী ঘটেছে যে এভাবে চুক্তিটা হলো! আন্তর্জাতিক চাপ যখন মিয়ানমারের ওপর ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন এত তাড়াহুড়া কেন। রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যদি আবার শিবিরে থাকে, তবে আবার নিগ্রহের শিকার হবে। এটা হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো টেকসই হবে না।