রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আরও তিন ব্যাংক

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নতুন ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখনো বিদেশি বড় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু করতে পারেনি নতুন কোনো ব্যাংক। এসব ব্যাংকের সঙ্গে কেউ বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী হচ্ছে না। অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ কিনে দেশীয় ব্যবসা করে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে এ ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে দুটি ব্যাংকের পরিচালকদের আর্থিক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে।

এই বাস্তবতা সত্ত্বেও সরকার আবার নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বর্তমান মেয়াদের শেষ সময়ে সরকার আরও তিনটি ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে চায়।

বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ৯ ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে—এমন আশায় প্রবাসী উদ্যোক্তাদের রয়েছে তিনটি ব্যাংক। যদিও চার বছরে সে ভূমিকা রাখতে পারেনি ব্যাংক তিনটি। 
অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে দীর্ঘদিন ধরে নতুন অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি পরিস্থিতি চরম খারাপ হলে গত সোমবার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে।

এর মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, দুটি নয়, লাইসেন্স দেওয়া হবে আরও তিনটি ব্যাংকের।

এত ব্যাংক থাকতে আরও ব্যাংক কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী যুক্তি দেখান, দেশের অনেক মানুষ এখনো ব্যাংক–সেবার বাইরে রয়েছে। তাই আরও ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। আগের দফায় নতুন লাইসেন্স পাওয়া ব্যাংকের অনেকগুলোর অবস্থা তত ভালো নয়, তারপরও আবার ব্যাংকের লাইসেন্স—এই পাল্টা প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, অসুবিধা কী? যারা পারবে না, তারা একীভূত হয়ে যাবে বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের আর্থিক বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংক দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি দেখি না। অন্য বিবেচনায় ব্যাংক দেওয়া হলে তার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে, তা ভেবে দেখা উচিত। দেশে ব্যবসায়ের পরিধি সেভাবে বাড়েনি, দক্ষ লোকবলও গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে এত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারকি করাও কঠিন।’

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পুরোপুরি এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে উদ্যোগী হয়। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েই নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) ‘সীমান্ত ব্যাংক’ নামের আরেকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এর আগের যে নয়টি ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল, তার তিনটির অবস্থা খুবই খারাপ। এরপরও নতুন করে কোনো ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। এ জন্য কোনো যুক্তি সমর্থনযোগ্য নয়।’

নতুন তিন ব্যাংকে পাচ্ছেন যাঁরা : চলতি বছরের শুরুর দিকে প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন নতুন একটি ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেন। প্রস্তাবিত ওই ব্যাংকটির নাম ‘বাংলা ব্যাংক’। বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান নোয়াখালী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ মোরশেদ আলম তাঁর ভাই, যিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান। জসীম উদ্দিন নিজেও ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার।

অন্য একটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসেবে লাইসেন্সের আবেদনকারী চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের রহমতপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী এম এ কাশেম। প্রস্তাবিত এ ব্যাংকের নাম ‘পিপলস ইসলামী ব্যাংক’। এম এ কাশেম যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের অংশ জোগাড়ে তিনি এরই মধ্যে উদ্যোক্তা খোঁজা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার এম এ কাশেমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা দিলেও কোনো জবাব দেননি তিনি।

 কয়েক মাস আগে এ দুটি ব্যাংকের লাইসেন্সের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত চায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এই সময়ে আর কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া যাবে না বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে মত জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্প্রতি ওই দুটি ব্যাংকের লাইসেন্সের ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সম্মতি রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে। সরকারের মেয়াদ শেষের আগেই ব্যাংক দুটির অনুমোদন দিতে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান গতকাল বলেন, ‘আমরা আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত চেয়েছি।’ এর বাইরে কোনো কথা বলতে চাননি তিনি।

এ ছাড়া পুলিশ ব্যাংক নামে আরেকটি ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্যও সরকারের কাছে আবেদন রয়েছে। ৪০০ কোটি টাকা জোগাড় করতে পারলেই ব্যাংক পাবে তারা। পুলিশ চায়, অন্য বাহিনীর মতো কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে চলবে তাদের এই ব্যাংক।

যেভাবে চলছে নতুন ব্যাংক : ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া নতুন নয়টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে প্রবাসীদের উদ্যোগে তিনটি ও দেশীয় ছয়টি। দেশীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয়কর উপদেষ্টা এস এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমানের মেঘনা ব্যাংক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইউনিয়ন ব্যাংক, সরকারদলীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসের মধুমতী ব্যাংক এবং বাগেরহাটের ব্যবসায়ী এস এম আমজাদ হোসেনের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণেই এসেছে এগুলো ভালো চলছে না। এর মধ্যে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে পড়েছে ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়ালের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ব্যাংকগুলো পুরোনো ব্যাংকের ঋণ কিনছে। পুরোনো গ্রাহকদের ঋণ বাড়িয়ে মুনাফা করার চেষ্টা করছে তারা। শুধু তা-ই নয়, অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে নিজ ব্যাংকে টানছে। ফলে পুরো ব্যাংক খাতেই অস্থিরতা চলছে।

এদিকে বিদেশি বড় ব্যাংকের সঙ্গে এখনো কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি নতুন কোনো ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য সেভাবে করতে পারছে না। সম্পর্ক স্থাপন না করার যুক্তি হিসেবে বিদেশি ব্যাংকগুলো বলছে, এসব রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমতি পাওয়া ব্যাংক।

পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘বাংলাদেশে নতুন ব্যাংক পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকবলের অভাব আছে। নতুন করে ব্যবসারও প্রসার ঘটেনি। ফলে জনবল ও ব্যবসা—দুটিই পুরোনো ব্যাংক থেকে টানাটানি করে আনতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হচ্ছে না। বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে তা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক ব্যবসা ছাড়া যেকোনো ব্যাংকের মুনাফা করা কঠিন। ফলে নতুন ব্যাংকগুলো এখনো সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’

স্বপ্ন ভঙ্গ করল প্রবাসী তিন ব্যাংক : প্রবাসীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা তিন ব্যাংকও ২০১৩ সালেই কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ফরাছত আলীর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইকবাল আহমেদের এনআরবি ব্যাংক ও নিজাম চৌধুরীর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। এর মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ—সব ক্ষেত্রেই বড় অনিয়ম হয়েছে।

অনুমোদন পাওয়ার সময় এ তিন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছিল, প্রবাসী আয় সংগ্রহ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রপ্তানি বাণিজ্যে তারা ভূমিকা রাখবে। এখন পর্যন্ত সেভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেনি এ তিন ব্যাংক। গত অক্টোবর মাসে এ তিন ব্যাংকের মাধ্যমে যে আয় এসেছে, তার যোগফল ১০ লাখ ডলারের কম। দায়িত্বশীল ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বপ্ন ভঙ্গ করেছে প্রবাসী ব্যাংকগুলো।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ