লঞ্চ ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ছে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ চলার মধ্যেই ঢাকা-বরিশাল নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ছে। বর্তমানে সরাসরি ঢাকা-বরিশাল নৌপথে ২০ টির মতো লঞ্চ চলাচল করে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরও ৭-৮টি নতুন লঞ্চ নামবে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা, যা এখন নির্মাণ পর্যায়ে আছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পরও ভবিষ্যতে নৌপথে যাত্রী বাড়বে। এতে লঞ্চ ব্যবসায় ভাটা পড়ার আশঙ্কা নেই। নৌপথে যাত্রী বাড়বে, এমন প্রত্যাশার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করেন তাঁরা। প্রথমত, নৌপথে ব্যয় কম। দ্বিতীয়ত, লঞ্চে যাতায়াতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় না এবং ক্লান্তি তৈরি হয় না। সর্বশেষ কারণ হলো, এখন বিলাসবহুল বড় বড় লঞ্চ তৈরি হচ্ছে। এতে বাসের চেয়ে লঞ্চে ভ্রমণে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে মানুষের চলাচল বাড়বে, এতেও লঞ্চে যাত্রী বাড়বে বলে আশা করছেন লঞ্চমালিকেরা।
সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ ৫১ শতাংশ শেষ করেছে। ২০১৯ সালে এ সেতু চালু হওয়ার কথা। জানতে চাইলে লঞ্চ ব্যবসায় বিনিয়োগকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের মানুষের জন্য খুব দরকার। কিন্তু এ সেতু চালু হলে লঞ্চে যাত্রী কমে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, একজন মানুষকে বাসে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে ৫০০-৬০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। বিপরীতে লঞ্চে ভাড়া মাত্র ২০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘এ চিন্তা করেই লঞ্চে বিনিয়োগ বাড়ছে। আমরাও নতুন দুটি লঞ্চ তৈরি করছি।’
রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের অনেক পুরোনো বাহন লঞ্চ। এ ব্যবসার উদ্যোক্তারা জানান, ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে বা পথে লঞ্চ চলে। তবে সবচেয়ে বড় লঞ্চগুলো চলে ঢাকা-বরিশাল রুটে। এ রুটে ১৯৯০ সালের দিকে অ্যাটলাস সন, রাজহংস, দ্বীপরাজ ইত্যাদি ছোট ছোট লঞ্চ চলত। এরপর সাগর নামে একটি বড় লঞ্চ এ পথে প্রথম চলাচল শুরু করে। বছর দশেক আগেও একটি লঞ্চ তৈরিতে ব্যয় হতো ছয়-সাত কোটি টাকা। এখন লঞ্চের আকার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিনিয়োগের পরিমাণ। তবে এখনকার বিলাসবহুল ও আধুনিক প্রযুক্তির বড় লঞ্চের যাত্রা শুরু হয়েছে ছয়-সাত বছর আগে থেকে। উদ্যোক্তারা জানান, নতুন করে লঞ্চ আনছে পারাবত, কীর্তনখোলা, সুন্দরবন, সুরভি, আগরপুর নেভিগেশনসহ কয়েকটি কোম্পানি।
ঢাকা-বরিশাল পথে লঞ্চের সাধারণ যাত্রীদের ভাড়া বর্তমানে ২০০ টাকা। ঈদের মৌসুমে এ ভাড়া বেড়ে হয় ২৫০ টাকা। একজন যাত্রীর ‘সিঙ্গেল’ কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ও দুজন যাত্রীর ‘ডাবল’ কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ৮০০ টাকা। বিজনেস ক্লাসের একটি কেবিনের ভাড়া ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। ডাবল কেবিনে দুজনের বেশি যাত্রী উঠলে অতিরিক্ত যাত্রীর জন্য ২০০ টাকা করে ডেকের টিকিট কাটতে হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, লঞ্চ সাধারণ মানুষের জন্য যেমন সাশ্রয়ী পরিবহন, তেমনি ব্যবসাও লাভজনক। বরিশালের লঞ্চ কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম সুরভি নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন-উল কবির বলেন, এখন একটি বড় লঞ্চ তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ লঞ্চের মেয়াদ থাকে ৩০ বছর। তবে লগ্নির পুরো অর্থ উঠতে সময় লাগে সাত থেকে আট বছর। অবশ্য দুই বছর পরপর লঞ্চের সংস্কার করাতে হয় এবং কমবেশি পাঁচ বছর পর সাজসজ্জা পরিবর্তন করতে হয়। তিনি বলেন, এ ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে কয়েক বছর পরপর নতুন লঞ্চ নামাতে হয়। এ ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের লগ্নির পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ আছে। ব্যবসায়ীদের ঋণ খেলাপি হওয়ার ঘটনা খুবই কম।
রেজিন-উল কবির জানান, অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলের জন্য তৈরি একটি লঞ্চ ৯০ মিটার বা ২৯৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। চওড়া করা যায় ৫২ ফুট পর্যন্ত। এর বেশি লম্বা বা চওড়া করার অনুমোদন নেই। এখন লঞ্চে হাইড্রলিক সুকান ব্যবহার করা হচ্ছে, এতে আঙুল দিয়েই লঞ্চ ডানে-বাঁয়ে ঘোরানো যায়। আগে এ পদ্ধতি ছিল ম্যানুয়াল বা হস্তচালিত।
এ ছাড়া বড় লঞ্চে এখন ইকো-সাউন্ডার প্রযুক্তি যোগ হয়েছে। এতে পানির গভীরতা বোঝা যায়। ফলে লঞ্চ চরে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি কমেছে। অত্যাধুনিক লঞ্চ এখন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার করে চলে। ফলে কুয়াশার মধ্যেও পথ হারানোর ভয় থাকে না। কোনো বিপদে আশপাশের লঞ্চের চালক বা সারেংয়ের সঙ্গে কথা বলার প্রযুক্তিও বড় লঞ্চগুলো যোগ করেছে। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে পর্যটনের ক্ষেত্রে লঞ্চ ব্যবসা অনেক বড় অবদান রাখবে। আমরা চিন্তা করছি, ভবিষ্যতে লঞ্চে করে ঢাকা থেকে সুন্দরবন, কুয়াকাটা ও অন্যান্য এলাকায় পর্যটনে বিনিয়োগ করব। অবশ্য এ জন্য লঞ্চগুলোকে সমুদ্রে যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে।’
লঞ্চ ব্যবসা বরিশালের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি মর্যাদার বিষয় বলেও উল্লেখ করে সুরভির রেজিন-উল কবির। তিনি বলেন, শহরের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীকে মানুষ চেনে না। কিন্তু লঞ্চ ব্যবসায়ীদের সবাই চেনে।
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে নাব্যতা রক্ষার ওপর জোর দেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, নদীতে পর্যাপ্ত গভীরতা না থাকলে বড় লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না। এটাই এ ব্যবসার জন্য বড় চিন্তার কারণ। বরিশাল জেলা লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি আজিজুল হক আক্কাস বলেন, ভবিষ্যতে এ ব্যবসার বড় সমস্যা হলো নদী। নদীতে নাব্যতা না থাকলে লঞ্চ চলবে কী করে। নদী নিয়মিত খনন বা ড্রেজিং করতে হবে। তিনি বলেন, নৌপথে যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও অনেক সাশ্রয়ী। তাই পদ্মা সেতু এ ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।