সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার খর্ব
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার খর্ব হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতিরা সরেজমিন পরিদর্শনকালে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলেও এখন তাঁরা তদন্ত করতে পারবেন না। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট প্রাথমিক সত্যতা নিরূপণে সরকারকে অবহিত করে দরকারি ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেবেন। জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭ গত সোমবার জারি করা হয়।
অথচ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ‘তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা’ শুধু হাইকোর্ট বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ রাখা হয়নি। তবে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান’ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত রয়েছে।
১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী সরকারের তৈরি করা খসড়া শৃঙ্খলাবিধি গত বছরের ২৮ আগস্ট সংশোধন করে চূড়ান্ত খসড়া করেছিলেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার দরকার নেই। এরপর দীর্ঘ অচলাবস্থা শেষে সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এর আগে সরকারকে যে খসড়া করে দিয়েছিলেন, তা থেকে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এর কোনোটিই বিচারপতি সিনহার প্রবর্তন করা কোনো বিষয় ছিল না। যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যগতভাবে যে প্রথা চলছিল, সেটাই বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার তা নাকচ করেছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে মাসদার হোসেন মামলার প্রধান আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম গতকাল বলেন, তিনি তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে চান না। আজ মাসদার হোসেন মামলার বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদারও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মাসদার হোসেন গত রাতে বলেন, ‘এ ধরনের বিধিমালা দিয়ে “দ্বৈত শাসন” দূর করা যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের পৃথক্করণ চাইলে আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে হবে।’
প্রসঙ্গত, আপিল বিভাগের নির্দেশনার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে ২০০৭ সালে সার্ভিস গঠন, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ-সংক্রান্ত বিধিমালা এবং কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করা হয়। কিন্তু এবারের প্রজ্ঞাপন জারির কারণ হিসেবে আপিল বিভাগের আদেশের কোনো উল্লেখ নেই।
কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি অভিযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রাথমিক অনুসন্ধান বা তদন্ত শুরু করতেন। সরকারের পরামর্শ নিতেন না। অলিখিত এই বিধান নির্দিষ্টভাবে কোনো প্রধান বিচারপতি চালু করেননি। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এটা চলছে। নতুন বিধি এই নিয়মে বাধা তৈরি করেছে। এখন সরাসরি কোনো অভিযোগ পেলেও সুপ্রিম কোর্টকে তা সরকারের নজরে আনতে হবে। প্রাথমিক অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা কে হবেন, সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব দেবে। এর ওপর সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দেবেন।
আপিল বিভাগের সর্বশেষ নির্দেশনা-সংবলিত খসড়া বিধিমালা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করতে রাষ্ট্রপতি রাজি হননি। ওই খসড়ায় বলা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি অভিযোগ পেলে এবং তা উপযুক্ত মনে করলে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেবেন। কিন্তু এখন তা পারবেন না। সুপ্রিম কোর্ট শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিতে বলতে পারবেন। ব্যবস্থা নেওয়া না-নেওয়া একান্তভাবেই সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলেন, দীর্ঘদিনের রেওয়াজ হলো, সরকার সরাসরি কোনো অভিযোগ পেলে তার প্রাথমিক তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে প্রস্তাব পাঠাত সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করলে তদন্ত শুরু হতো। এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি কখনো। তবে একবার কক্সবাজারের জেলা জজ মোক্তার আহমেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই করেছিল আইন মন্ত্রণালয়। তখন সুপ্রিম কোর্ট ওই পদক্ষেপে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জি এ) কমিটি এ ধরনের পদক্ষেপ না নিতে সতর্ক করে দেন।
আপিল বিভাগের খসড়া বিধিমালায় (বিধি ৩) বলা হয়েছিল, যদি সরকার এ রকম অভিযোগ পেলে তা সুপ্রিম কোর্টে পাঠাবেন। প্রথমবারের মতো বিধান করা হয়েছিল যে জি এ কমিটি প্রাথমিক সত্যতা নিরূপণের প্রয়োজন মনে করলে ওই বিচারকের কাছে ১৫ দিন সময় দিয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চাইবে। এরপর জি এ কমিটি চাইলে এক বা একাধিক অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার নামসহ অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আইন ও বিচার বিভাগকে পরামর্শ দেবে।
নতুন বিধিমালায় ওই বিধান রাখা হয়নি। এখন বলা হয়েছে, সরকার যদি মনে করে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, তাহলে তারা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করবে।
আপিল বিভাগের খসড়ার ২৩ বিধিতে বলা ছিল, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রমের কোনো বিষয় জড়িত থাকলে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হলে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে সরাসরি পরামর্শ দেওয়ার আগে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির মতামত নেবেন। এ ছাড়া যদি হাইকোর্টের কোনো বিচারকের সরেজমিনে আদালত পরিদর্শনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়, সে ক্ষেত্রেও সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারকের মতামত নেবেন। নতুন বিধিতে এটা পুরোপুরি বাদ পড়েছে।
আপিল বিভাগের খসড়ায় ৩২ বিধির উপবিধি ২-এর শর্তে বলা ছিল, যদি অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয় এবং তা সেখানে চলমান থাকাকালীন যদি তিনি অবসরে যান, তাহলে সরকার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কিংবা সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠাতে পারবেন। এটিও পুরোপুরি বাদ পড়েছে।
উল্লেখ্য, অবসরে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চলমান বিভাগীয় মামলার অপমৃত্যু ঘটে। বিচারপতি সিনহাসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা চেয়েছিলেন বিচারকদের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনতে। কিন্তু সরকার দুদকে পাঠানোর বিধান বাদ দিয়েছে।
নতুন বিধি ২৭(৭) এ বলা হয়েছে, সার্ভিসের কোনো সদস্য বিভাগীয় মামলায় দণ্ডের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন না করলেও রাষ্ট্রপতি স্বীয় ইচ্ছায় বা অন্যবিধ কারণে বিভাগীয় মামলার নথি তলব করে নিজ বিবেচনায় দণ্ডের আদেশ সংশোধন করতে পারবেন। অথচ আপিল বিভাগের আদেশে ছিল, বিভাগীয় মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিচারক দণ্ডের আপিলের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তার বিবেচনামতে প্রয়োজনীয় আদেশ দেবেন।
দুই বিধানের মূল পার্থক্য হলো, রাষ্ট্রপতিকে নিজ উদ্যোগে কারও দণ্ড সংশোধনের এখতিয়ার খসড়ায় দেওয়া হয়নি। নতুন বিধিমালায় তা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অবস্থাটা দাঁড়াল, কোনো দণ্ডিত বিচারককে আবেদন করতে হবে না। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে না। তিনি রাষ্ট্রপতির দ্বারা বেকসুর খালাস পেতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রিম কোর্ট এমন অনেক বিষয়ে তদন্ত করেছেন, যেখানে আইন মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ দেখা যায়নি।
যেমন সুপ্রিম কোর্টের চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ মফিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এক হত্যা মামলার আসামির সঙ্গে ২২ বার মুঠোফোনে কথোপকথন এবং পরে আসামির খালাস পাওয়ার বিষয়টি সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই প্রধান বিচারপতি সিনহা তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্ট এরপর সরকারকে বিভাগীয় মামলা করার পরামর্শ দেন। অবশ্য ওই মামলা চলমান অবস্থাতেই অভিযুক্ত বিচারক অবসরে যান। এখন আর প্রধান বিচারপতি বা হাইকোর্ট এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পরও প্রাথমিক তদন্ত করতে পারবেন না। তাঁরা শুধু আইন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন।
অধস্তন আদালতের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি অভিযোগ এলে সে বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করার যৌক্তিকতা নিরূপণ এবং প্রয়োজনে ওই অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগের নিমিত্তে মতামত প্রদানের জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে সভাপতি এবং বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শওকত হোসেনকে সদস্য করে ১৯৭৩ সালের হাইকোর্টের রুলস অনুযায়ী একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৩১ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নির্দেশে গঠিত হওয়ার পর বিশেষ কমিটি এ পর্যন্ত ৯টি বৈঠকে বসেছে। বর্তমান প্রজ্ঞাপনের বিধি ৩ ও ৪-এর কারণে ওই কমিটি অকার্যকর হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সময়সীমা
সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে সব থেকে গুরুতর বিষয় ছিল সময়সীমা। বিচারপতি সিনহার আমলে আদেশ বাস্তবায়ন নিয়ে নানা সময়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। আপিল বিভাগের খসড়ায় সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। বিধি ৩(১) এ বলা ছিল, অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে অভিযুক্ত কর্মকর্তা জবাব দেবেন। এখন কোনো সময় নেই। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এখন তা নেই। খসড়া বিধি ২৯-এ বলা ছিল, যদি সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া কোনো পরামর্শ বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে, তাহলে আইন মন্ত্রণালয় ৭ দিনের মধ্যে বিলম্বের কারণ সুপ্রিম কোর্টকে জানাবে এবং পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে সেই পরামর্শ বাস্তবায়ন করবে। ওই পরামর্শ যথাসময়ে বাস্তবায়নে কোনো কর্মকর্তা ব্যর্থ হলে তাঁর বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা যাবে। নতুন ২৮ বিধিতে এসব বাদ দিয়ে শুধু বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়সীমা আইন মন্ত্রণালয় ‘যথাসম্ভব অনুসরণ’ করবে।