বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: লুটপাট হওয়া টাকার ভাগ সরাসরি নিয়েছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। চেয়ারম্যান থাকার সময়ই স্ত্রী শেখ শিরিন আখতার, পুত্র শেখ সাবিদ হাই অনিক ও মেয়ে শেখ রাফা হাইকে সঙ্গে নিয়ে খুলেছিলেন ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১১ মাসেই জমা হয় ১৩ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ও নগদে জমা হওয়া এসব টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া টাকা সরাসরি জমা হয়েছে বাচ্চু ও তাঁর ভাই শাহরিয়ার পান্নার ব্যাংক হিসাবে। এভাবে ২০১২ ও ২০১৩ সালে দুজনে মিলে ৩০ কোটি টাকার বেশি অর্থ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন ও বাচ্চুর ব্যাংক হিসাব বিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০১৪ সালেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে এসব তথ্য পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও দুদক কোনো মামলায় শেখ আবদুল হাইকে অন্তর্ভুক্ত করেনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে উঠে এসেছে, বিভিন্ন গ্রাহকের ঋণের একটা অংশ সরাসরি জমা হয়েছে আবদুল হাই বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে। ভাগের বাকি অংশ গেছে তাঁর ভাই শাহরিয়ার পান্নার মালিকানাধীন বিএম কম্পিউটারস ও ক্রাউন প্রোপার্টিজের হিসাবে। ব্যাংকটির গুলশান শাখা থেকে এশিয়ান ফুড ট্রেডিংকে ৭৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পেয়েই গ্রাহক ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা সরাসরি জমা করেন আবদুল হাই বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে। একই প্রক্রিয়ায় ভাগের আরেক অংশ জমা হয় তাঁর ভাই পান্নার প্রতিষ্ঠানের হিসাবে। এভাবে গ্রাহকদের ঋণ হিসাব থেকে সরাসরি ৩০ কোটি টাকা নিয়েছেন দুই ভাই বাচ্চু ও পান্না।
যোগাযোগ করলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচার বিভাগ থেকে নির্দেশ আসার পরই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি সংস্থার তদন্তেই তাঁর দুর্নীতির প্রমাণ মিলছে। তাঁর হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে, অন্য প্রতিষ্ঠানের টাকাও গেছে। দেরি না করে দুদকের উচিত হবে দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে যাওয়া।
চেয়ারম্যানের নিজের কোম্পানি
জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাবেক সাংসদ শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খোলেন তিনি। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের পরিচালক হিসেবে রাখেন এ প্রতিষ্ঠানে। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া হয় ৪২/১-ক জাহান প্লাজা, সেগুনবাগিচা। গতকাল মঙ্গলবার ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মেলেনি।
ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড যে কাগুজে প্রতিষ্ঠান, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে। এ প্রতিষ্ঠানের সনদ ছাড়া মাছ রপ্তানি ব্যবসা করা যায় না। অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘ইডেন ফিশারিজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের সমিতির সদস্য না। মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি করতে হলে অবশ্যই আমাদের সদস্য হতে হবে।’
ব্যাংকে খোলা হিসাবে ইডেন ফিশারিজের ঠিকানা হলো বনানী ডিওএইচএসের ৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাসার পঞ্চম তলা। গতকাল বিকেলে ওই ভবনে গিয়ে জানা যায়, সেটি বাচ্চুর নিজস্ব ফ্ল্যাট। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই সেখানে। ২০১৪ সালের ৫ জুলাই পদত্যাগের আগ পর্যন্ত ওই ভবনেই থাকতেন তিনি। ব্যাংকের অনিয়মের পর আলোচনায় এলে ওই বাসা ছেড়ে যায় তাঁর পরিবার। বর্তমানে সেখানে কেউ থাকে না।
বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবের বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইডেন ফিশারিজের ব্যাংক হিসাবে ২০১৩ সালের ২ মে ১০টি চেকের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা করে ৫ কোটি টাকা তোলা হয়। পরের দিন ওঠানো হয় আরও ১ কোটি টাকা। সেদিন দুটি চেকের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা করে নগদ জমা হয় ১ কোটি টাকা। ওই বছরের ১৬ মে দুটি চেকের মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা তোলা হয়। আবার দুটি চেকের মাধ্যমে জমা হয় ৫ কোটি টাকা। কোনো ব্যবসা না থাকার পরও এভাবে মাত্র ১১ মাসেই ১৩ কোটি টাকা জমা হয় এ হিসাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণ পাওয়ার পর ভাগের একটা অংশ দিতে হয়েছে চেয়ারম্যান ও তাঁর ভাইকে। এসব অর্থের একটা অংশ জমা হয়েছে ইডেন ফিশারিজের হিসাবে। এমন আরও অনেক হিসাব রয়েছে তাঁদের। সারা বিশ্বে উত্তোলনের সুবিধার্থে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে হিসাব খুলেছিলেন তাঁরা।
দুই ভাইয়ের ভাগাভাগি
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক হিসাব খোলার আগেই বিএস এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ মঞ্জুর করে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকার পরও দফায় দফায় ঋণ বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা করা হয়। এ ঋণের হিসাব থেকেই শাহরিয়ার পান্নার মালিকানাধীন বিএম কম্পিউটারসে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ও ক্রাউন প্রোপার্টিজের হিসাবে জমা হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এঞ্জেল অ্যাগ্রোকে ৩২ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকটি। এর দেড় কোটি টাকা যায় পান্নার ক্রাউন প্রোপার্টিজের হিসাবে। টাইম ট্রেড ইমপেক্সের ১১ কোটি টাকার মধ্যে ১ কোটি টাকা যায় ক্রাউন প্রোপার্টিজের হিসাবে। এ ছাড়া ২০ লাখ টাকা যায় সিপার আহমেদের হিসাবে। এবি ট্রেড লিংককে ৬৬ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা জমা হয় সিপার আহমেদের হিসাবে।
এশিয়ান ফুড ট্রেডিংকে ৭৯ কোটি টাকা ঋণ দেয় গুলশান শাখা। ঋণের ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা সরাসরি জমা হয় আবদুল হাই বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে। ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজকে ৭৬ কোটি টাকা দেয় ব্যাংকটি। এর মধ্যে আবদুল হাই বাচ্চুর নামে হওয়া শেখ আবদুল হাই কলেজের হিসাবে যায় ১০ লাখ টাকা।
২০১২ সালের ২২ মে ডেলটা সিস্টেমস লিমিটেডের নামে ৫০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব আসে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক মতামত সত্ত্বেও পরদিনই প্রস্তাবটি পর্ষদের সভায় অনুমোদন করা হয়। একই বছরের ১৩ জুন ঋণের অর্থ ছাড় হয়। এ হিসাব থেকেই পরের দিন ক্রাউন প্রোপার্টিজের ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি টাকা জমা হয়। লাইফস্টাইল ফ্যাশনকে দেওয়া ৫৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৮ কোটি টাকা সরাসরি জমা হয় ক্রাউন প্রোপার্টিজের হিসাবে। ধ্রুব ট্রেডার্সকে দেওয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে ৮০ লাখ টাকা যায় ক্রাউন প্রোপার্টিজে। আর সে সময়ে গুলশান শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনকারী সিপার আহমেদের হিসাবে গেছে ৯ কোটি টাকা। তাঁর ভাই শাকিল আহমেদের হিসাবেও গেছে ঋণে অর্থের একটা অংশ।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুল হাই যোগদান করার কিছুদিন পরই ব্যাংকটি খারাপ হতে শুরু করে। ২০১২ সাল থেকে ব্যাংকটির খারাপ অবস্থা সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৪ সালে ব্যাংকটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়লে তাঁকে নিরাপদে পদত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা অনিয়মের জন্য তাঁকে বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠলেও আমলে নেওয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রীও সংসদে ও বাইরে একাধিকবার বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে দুদক আবদুল হাই বাচ্চুসহ পর্ষদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।