দুর্নীতি রুখতে পারবেন পুতিন ?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রাশিয়ায় সম্প্রতি ঘুষ নেওয়ার অপরাধে অর্থনৈতিক উন্নয়নমন্ত্রী আলেক্সেই উলিইউকায়েভের আট বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। রায়ের পরপরই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনা দেখে মনে হতে পারে, দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর প্রশাসন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আসলে কি তাই?
দুর্নীতি রাশিয়ার বড় ধরনের জাতীয় সমস্যা। এটিকে দেশটির সামগ্রিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়। শুধুমাত্র দুর্নীতির কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। সরকার তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হতে চাচ্ছে। এই মন্ত্রী ছাড়াও শাখালিনের গভর্নর আলেক্সান্দার খোরোশাভিন ও কিরোভের গভর্নর নিকিতা বেলিখের মতো ক্ষমতা কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা রাজনীতিকদের দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করছে না পুতিন প্রশাসন।
আলেক্সেই উলিইউকায়েভকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা রাশিয়ায় এখন খুবই আলোচিত। বলা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে তাঁর মতো কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঘুষ নেওয়ার অপরাধে জেলে পাঠিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন আদালত। একটি দেশীয় তেল কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার দায়ে দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছেন তিনি। সঙ্গে ২০ লাখ ২০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হবে।
অর্থনৈতিক সংকট ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠে রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার গুরু দায়িত্ব ছিল আলেক্সেই উলিইউকায়েভের ওপর। তিনি ২০১৩ সালের ২৪ জুন থেকে এ বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন।
গত বছরের নভেম্বরে গোয়েন্দা বাহিনী এফএসবির এক অভিযানে গ্রেপ্তার হন আলেক্সেই। তদন্তকারী একটি সূত্রের বরাত দিয়ে তাস অনলাইন জানায়, আলেক্সেই ও তাঁর সহযোগীর কথাবার্তার রেকর্ড থেকে অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁকে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক ছাড়পত্র পাওয়ার পরই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি বাশনেফটের ৫০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রসনেফট কিনে নেয়। রসনেফটের চেয়ারম্যান ইগর সেচিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই তিনি গ্রেপ্তার হন। সেচিনকে পুতিনের পরই রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ধরা হয়। মন্ত্রীর গাড়িতে পাওয়া ব্যাগে ২০ লাখ ডলার নগদ অর্থ পাওয়া যায়। বিশাল অংকের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করা হয়।
আলেক্সেইকে গ্রেপ্তারের পরই দেশটির দুর্নীতি দমন সংস্থা জানায়, তিনি রসনেফটের প্রতিনিধিদের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করেন। তিনি ঘুষ নিয়েছেন ও হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। তাঁকে নিয়ে আরও চাঞ্চচল্যকর তথ্য দিয়েছেন রুশ গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা আলেগ ফেওকতিতোভ। তিনি সেচিনের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস ফোরাম চলাকালে ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি আলেক্সেই ইঙ্গিত দেন। ওই সময় দুই আঙ্গুলের ইশারা দিয়ে কত টাকা ঘুষ নিতে চান তা জানিয়ে দেন এবং তা ছিল দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) ডলারের সমান।
আদালত আলেক্সেই উলিইউকায়েভের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে বলেন, তিনি যে ঘুষ নিয়েছেন তা প্রমাণিত। এ কারণেই তাঁকে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তবে রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অকল্পনীয় ষড়যন্ত্র করা হয়। পুরো ঘটনা একটি সার্কস।’ আর তাঁর আইনজীবী তিমোফেই গ্রিদনেভ বলেছেন যে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি কিন্তু আদালতে প্রমাণিত হয়নি। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানান তিনি।
রাশিয়ার সরকরি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পুতিন প্রশাসন মরিয়া হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি দমন করতে তাই ক্রেমলিনের নীতি হচ্ছে জিরো টলারেন্স। চলতি বছরের মার্চে আরখানগেলস্কে অনুষ্ঠিত আর্কটিক ফোরামে পুতিন বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। কারণ, এটি আমাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা। তবে ইদানিং দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমেছে; অন্তত সামাজিক জরিপ তাই বলছে।’ এর সঙ্গে পুতিন যোগ করেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় চাই, দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকুক।’গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে রাশিয়ায় দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। দেশটির প্রসিকিউটর জেনারেল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে দুর্নীতির পরিমান ১৪ শতাংশ কমেছে।
রুশ গণমাধ্যম লেন্তা ডট রু জানায়, ২০১৬ সালে রাশিয়ায় ঘুষ নেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন রুবল (প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার) যা ২০১৫ সালের চেয়ে ১ বিলিয়ন রুবল বেশি ছিল। এটা শুধু ঘুষ নিয়ে ধরা পড়া অর্থের পরিমাণ।
দুর্নীতিতে গত পাঁচ বছরে বিশ্বে রাশিয়ার অবস্থান
সাল | স্কোর | অবস্থান |
২০১৬ | ২৯ | ১৩১ |
২০১৫ | ২৯ | ১১৯ |
২০১৪ | ২৭ | ১৩৬ |
২০১৩ | ২৮ | ১২৭ |
২০১২ | ২৮ | ১৩৩ |
সূত্র: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল |
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকা নিয়ে ২০১৬ সালের যে সূচক প্রকাশ করেছে তাতে রাশিয়ার অবস্থান ১৩১ নম্বরে। লন্ডনভিত্তিক আরনস্ট এ্যান্ড ইয়ং নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও আফ্রিকা অঞ্চলে ব্যবসা খাতে দুর্নীতির পরিমাণ জানতে জরিপ চালানো হয়। তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান ১৬ নম্বরে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৬ ভাগ রুশ জানায়, তাদের নিয়মিত দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয়। গত মার্চে লেভেদা সেন্টারের আরেক জরিপে বলা হয়, ৪৮ শতাংশ রুশ মনে করেন যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রতি পাঁচজনের একজন মনে করেন যে প্রতিদিনের সমস্যাগুলো ঘুষ দিয়ে সমাধান করা যায়।
দুর্নীতি দমন সম্পর্কিত বিভাগের রুশ প্রসিকিউটর জেনারেল প্রধান আলেক্সান্দার রুছেসকী গাজেতা ডট রুকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেন, গত আড়াই বছরে দুর্নীতির অভিযোগে অন্তত ৪৫ হাজার অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৪০০ জন পার্লামেন্ট সদস্য ও আরও তিন হাজার স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করতেন।
আলেক্সেই উলিইউকায়েভের আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘুষের মামলায় গ্রেপ্তার হন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার ভারপ্রাপ্ত প্রধান। তাঁর মস্কোর ফ্ল্যাট থেকে নগদ ১২ কোটি ডলারের বেশি পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে ২০১২ সালে একটি বড় দুর্নীতির কেলেঙ্কারির জেরে তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনাতোলি সারদিউকভকে বরখাস্ত করা হয়।
সাম্প্রতিক এসব কর্মকাণ্ডে মনে করা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন পুতিন। আর এজন্য তাঁর সরকার ও সরকারি বিভিন্ন কাজে যুক্ত ব্যক্তিদেরও ছাড় দিচ্ছেন না তিনি। পুতিনের এসব পদক্ষেপ কী ফল বয়ে আনবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হলে যে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধাই নেই রুশদের মনে।