ঢাকার আতঙ্ক ছিনতাই
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ভোরবেলার ফাঁকা রাস্তা কিংবা মধ্যদুপুরের ব্যস্ত সময়, ঢাকার বাসিন্দারা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন যখন-তখন। সিসি ক্যামেরা, যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেট—এসব প্রযুক্তিতেও শনাক্ত হচ্ছে না ছিনতাইকারী বা তাদের ব্যবহৃত যানবাহনগুলো। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে না পারায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। থানা-পুলিশের মামলা না নেওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই।
হেঁটে, রিকশায়, বাসে বা নিজের গাড়িতে—যেভাবেই আপনি চলেন না কেন, ছিনতাইকারীদের নাগালের বাইরে যাওয়া কঠিন। গুলি করে বা ছুরি মেরে, কখনো অস্ত্রের ভয় দেখিয়েই সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল বা গাড়িতে করে এসে রিকশাযাত্রীদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টানে পড়ে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ভাড়া করা অটোরিকশায় খাঁচা লাগানোর পরে এখন ছাউনি কেটে নেওয়া হচ্ছে মুঠোফোন বা ব্যাগ। যানজটপ্রবণ ও জনবহুল এই শহরে মানুষ ঠিকমতো চলতে না পারলেও ছিনতাইকারীরা ঠিকই সবকিছু লুট করে পালিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা ধরা পড়ছে খুব কমই ।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি নিজের গাড়িতে বসে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা শাহীনা আক্তার ও তাঁর মেয়ে নাতিকা রিজওয়ানা। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। জসীমউদ্দীন সড়কে পৌঁছামাত্র চার মোটরসাইকেলে আসা কয়েকজন যুবক গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। তারা শাহীনা ও নাতিকাকে গুলি করে ৬ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যানজটের মধ্যেও পালিয়ে যায়। এরপর নয় মাস পেরিয়ে গেছে, ছিনতাইকারীরা শনাক্ত হয়নি। টাকা উদ্ধার তো দূরের কথা। শাহীনার ছোট ভাই ফরহাদ হোসেইন বলেন, ঘটনার পর র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ, থানার পুলিশ—সবাই এসেছিল। কিন্তু এরপর তাঁরা আর কিছু জানেন না। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের (উত্তর) সহকারী কমিশনার মহরম আলী বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, ক্লুই পাওয়া যায়নি।’
শুধু শাহীনা নন, দীর্ঘদিন রাজধানীতে থেকে ছিনতাইয়ের শিকার হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঢাকার রাস্তাগুলোতে ‘ছিনতাই’ নাগরিক আতঙ্কের অন্যতম কারণ হলেও পুলিশের খাতায় এর প্রতিফলন নেই। পুলিশের হিসাব বলছে, গত চার বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ক্রমাগত কমছে।
ছিনতাই কমছে!
পুলিশের হিসাবে ছিনতাই ক্রমাগত কমছে। তবে মানবাধিকারকর্মী, ভুক্তভোগীসহ অনেকেই এই হিসাবের সঙ্গে একমত নন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ২৫৬টি, ২০১৫ সালে ১৭২টি এবং ২০১৬ সালে ১৫০টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। আর এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ১৪২টি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নূরুল হুদা মনে করেন, অপরাধ কমে গেছে, এটা বলার জন্য পরিসংখ্যান কম দেখানোর ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মামলা নিতে হবে এবং দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ যখন দেখবে পুলিশের কাছে গিয়ে সে প্রতিকার পাচ্ছে, তখন পুলিশের ওপর তাদের আস্থা বাড়বে। এতে অপরাধও কমে আসবে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ছিনতাই কমেছে—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা মামলার সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যাবে না। অপরাধের সংখ্যা কম দেখানোর প্রবণতা থানার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছে।
গত চার দিনে রাজধানীতে ৩০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁদের ২৪ জনই বলেছেন, কোনো না কোনো সময়ে তাঁরা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তাঁরা জানান, পুলিশ খোয়া যাওয়া জিনিসপত্র তাঁদের হাতে তুলে দেবে—এমনটা ভাবতেই পারেন না। উপরন্তু থানায় মামলা করলে ‘হেনস্তার’ শিকার হওয়ার ভয় রয়েছে তাঁদের। তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তুলতে কেউ কেউ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আটজন জানিয়েছেন, মামলা করতে চাইলেও পুলিশ নেয়নি।
পুলিশ মামলা নেয় না—এই অভিযোগের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘খুব প্রচলিত অভিযোগ। হয় না যে তা বলব না, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আদার অপশন আছে। সিনিয়র অফিসারের কাছে রিপোর্ট করা যাবে, তাঁদের ফোন নম্বরও থানায় দেওয়া আছে। ভুক্তভোগীদের এই সুযোগটা নিতে হবে। একটা পরিস্থিতিকে তো হুট করেই কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় নিয়ে আসা যাবে না। পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই কার্যক্রমটা এগিয়ে নিতে হবে।’
দুই মাসে তিন খুন
সর্বশেষ গত দুই মাসে ছিনতাইকারীদের হাতে তিনজন খুন হওয়ার ঘটনা রাজধানীবাসীকে আরও আতঙ্কিত করেছে। গত সোমবার দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের হ্যাঁচকা টানে মায়ের কোল থেকে পড়ে মারা যায় ছয় মাস বয়সী আরাফাত। এর মাত্র ১৩ দিন আগে একইভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা যান জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ আলম (৪০)। আর গত ৮ অক্টোবর টিকাটুলিতে ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে তাদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু তালহা খন্দকারের।
ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গুরুতর যেসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয়, কেবল সেগুলোর ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে।
ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরার পথে ৬ ডিসেম্বর উত্তরা ১ নম্বরে ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তারা। শ্রমিকদের বেতনের ৪০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িতে করে ফিরছিলেন তাঁরা। ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে গাড়ি থামিয়ে সেই টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হলেও গত ১৫ দিনে কোনো সুরাহা হয়নি।
বিমানবন্দর খানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া গতকাল বলেন, ‘জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি, কোনো রিকভারিও নেই।’ কারখানার ব্যবস্থাপক রাসেল হাওলাদার বলেন, ‘ঘটনার পর র্যাব-পুলিশ সবাই এসেছিল, কিন্তু অগ্রগতি নেই।’
এক বছরের ব্যবধানে দুবার ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন বিকাশের পরিবেশক এভারলাস্ট পার্টনারসের কর্মচারীরা। দুই দফায় ছিনতাইকারীরা তাঁদের ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দুটি ঘটনায় মামলা করেছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ফরহাদ নিজাম আহমেদ।
ফরহাদ বলেন, এক বছর আগে বিমানবন্দর থানায় যে মামলাটি করা হয়েছে, পুলিশ সেই মামলায় আদালতে ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ (অর্থাৎ জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায়নি বা টাকা উদ্ধার করা যায়নি) দিয়েছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় দুই মাস আগে মামলা করলেও এখনো প্রতিকার পাননি।
তবে ডিএমপি সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ছিনতাই বন্ধ করা এবং ছিনতাইয়ের কাজে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের চিহ্নিত করার কার্যক্রম পুলিশ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই করছে। তিনি বলেন, ‘জনবহুল শহরে সব জায়গায় প্রতিটি ঘটনা আগেই কন্ট্রোল করা যায় না। কিন্তু যদি ঘটে যায়, সে ক্ষেত্রে তদন্ত করে জড়িতদের বের করার চেষ্টা করা হয়।’ তিনি বলেন, ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করা এবং গ্রেপ্তারে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের সফলতা আছে।
মামলা নেই, আছে আতঙ্ক
আর পুলিশের ভাষায় যেগুলো ‘ছোটখাটো’ ছিনতাইয়ের ঘটনা, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও আঘাতপ্রাপ্ত হন। আতঙ্ক স্থায়ী হয়। অফিস বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে মানুষ অহরহই এ রকম ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু থানায় যান না তাঁদের অধিকাংশই।
গত বছরের নভেম্বরে অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য জমি বন্ধক রেখে পাওয়া ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় আসার পরে ছিনতাই হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহরমের। কিন্তু একবারের জন্যও পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবেননি তিনি। কারণ হিসেবে তাঁর উত্তর, ‘থানা-পুলিশ করে লাভ কী? কিছুই তো হবে না।’
এনজিওকর্মী মিলন হালদার গত ২ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন। গাবতলী থেকে রিকশায় করে তিনি ও তাঁর এক সহকর্মী ফার্মগেটে যাচ্ছিলেন। এ সময় উল্টো পথে আসা একটি মোটরসাইকেলে কেতাদুরস্ত দুজন লোক তাঁর পায়ের কাছে থাকা ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে চলে যায়। মিলন এ ঘটনায় আগারগাঁও থানায় গিয়ে ‘জিনিসপত্র খোয়া’ গেছে মর্মে সাধারণ ডায়েরি করেন। মামলা করেননি কেন—এই প্রশ্নের জবাবে মিলনের উত্তর, ‘মামলা করে কী লাভ! জিনিসপত্র তো আর ফিরে পাব না।’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে টঙ্গী থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে খিলক্ষেতে ফেরার পথে হোটেল লা মেরিডিয়ানের উল্টো পাশে ছিনতাইয়ের শিকার হন নুমান খান নামে এক ছাত্র। ছিনতাইকারীরা তাঁর গলায় ছুরি ধরে ব্যাগে থাকা ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও কাগজপত্র নিয়ে যায়। নুমান খান বলেন, খিলক্ষেত থানায় তিনি মামলা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ মামলা না নিয়ে ‘জিনিসপত্র হারিয়েছে’ মর্মে সাধারণ ডায়েরি নিয়েছে।
দূরপাল্লার বাস, ট্রেন বা লঞ্চ থেকে রাজধানীতে নেমেই তিক্ত ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় অনেক মানুষকে। গত সেপ্টেম্বরে ফকিরাপুল এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন দিলারা সুলতানা নামের এক শিক্ষিকা। ট্রেন থেকে নামার পর একটি রিকশায় করে বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ প্রাইভেট কারযোগে এসে এক ব্যক্তি তাঁর হাতে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, মানুষ ছিনতাইয়ের মতো বিপদে পড়লে যে ধরনের সহায়তামূলক আচরণ পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা পায় না। এ জন্য অনেকই থানায় যেতে চায় না। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুলিশকে আরও গণমুখী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।