শহর রাঙামাটি টিকবে কি ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আকাশ থেকে রাঙামাটি শহর দেখতে অনেকটা এঁটো থালায় পড়ে থাকা মাছের কাঁটার মতো। কেউ যেন কুরে কুরে মাছটা খেয়েছে, এখন একা পড়ে আছে ফেলে দেওয়া কাঁটা। একটা মাছের কঙ্কাল যেন।
বন্দরনগর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি এই শহরের পত্তন এবং অধিকার নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য আর আরাকান রাজ্যে টানাটানিতে প্রথম ছেদ টানে মোগলরা, সেই ১৫৬৬ সালে। হালের রাঙামাটির সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা চাকমা জনগোষ্ঠীর পত্তন শুরু হয় ১৭৩৭ সাল থেকে শের মস্তা খানের আমল থেকে। মোগলদের বাতির তেল ফুরানোর দিন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজর পড়ে এই মুলুকে। ১৭৬০ থেকে ১৭৬১ সালে তারা ইজারা নিয়ে নেয় রাঙামাটির।
রাঙামাটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যার সীমান্তে আছে মিয়ানমার ও ভারত-দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান আর আজকের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিজলি বাতি জ্বালানোর প্রতিজ্ঞায় কাপ্তাই লেক সৃষ্টি করা হলে রাঙামাটি শহরটি মাছের কাঁটার রূপ পায়। অনেকেই কাপ্তাই লেক আর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে পাহাড়ের দুঃখ হিসেবেই বর্ণনা করে থাকেন। সারা দেশে বিদ্যুতের কিছুটা চাহিদা পূরণ করলেও পাহাড় কী পেয়েছে, সে হিসাব করতে গেলে মাছের কাঁটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না পাহাড়ের মানুষ।
সেই গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ধসের ঝুঁকি-এবারের (২০১৭ সালের ১৩ জুন) পাহাড়ধসে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে রাঙামাটি শহর আর শহরতলি এলাকা। লম্বা হয়ে (পূর্ব-পশ্চিম-রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ধরে) বাড়তে থাকা এই রাঙামাটি শহর ধসের ধকল সয়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে কি? আগামী বর্ষায় কী হাল হবে এই শহরের? বর্ষার আগে কী করলে এবার বর্ষায় প্রাণহানি আর ধস প্রতিরোধ করা যাবে? নাকি এঁটো থালায় পড়ে থাকা মাছের কাঁটাটি পিপীলিকার ক্ষুধায় পরিণত হবে?
এবারের ধসে পৌরসভার শুধু ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভেদভেদি, রাঙাপানি, মোন আদম, উদন্দি আদম, মোনঘর এলাকায় ২২ জন আদম সন্তান লাশে পরিণত হয় ঘুমের মধ্যেই, পাওয়া যায়নি আরও অনেককে। ঘরবাড়ি হারায় ২০৭টি পরিবার। ৫ নম্বর আর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একই দশা হয়। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আসাম বস্তি, বলাইছড়িপাড়া, তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া, খেপ্যাপাড়ার ১৪১টি পরিবার গৃহহারা হয়। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভালেদি বহারপুর, উলুছড়ায় এখন উদ্বাস্তু প্রায় ১৪২টি পরিবার। শুধু মানুষের বাড়িঘর, বস্তি, চারচালা ক্ষতি আর ঝুঁকি আছে তা-ই নয়, নানা সরকারি স্থাপনাও এখন দিন গুনছে-কী হয়! কী হয়!-টিকবে কি টিকবে না?
খুব ছোট করে এই তালিকা তৈরি করলেও কমপক্ষে ১৫টি জনগুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা এখন বড় হুমকির সম্মুখীন। এই ১৫টি স্থাপনা (যার মধ্যে আছে টিভি কেন্দ্র, বেতার ভবন, পাসপোর্ট অফিস, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, এসপি ভবন, মাধ্যমিক শিক্ষা ভবন, সার্কিট হাউস, রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভবন, সমাজসেবা কার্যালয়, স্থানীয় সরকার ভবন, ফিশারিজ ঘাট, মৎস্য ভবন) চলে গেলে রাঙামাটির থাকে কী?
তাহলে উপায় কী? রাঙামাটির জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যে অন্যতম চাঁদ রায়ের মতে, এখনই আমাদের স্বল্পমেয়াদি আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সত্বর কাজ শুরু করা উচিত। এ শহরকে টেকাতে হলে আমাদের হাতে সাকল্যে বড়জোর ১৫০ দিন সময় আছে। তাঁর মতে, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় চরম ঝুঁকিতে থাকা সড়ক আর ইমারতগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দু-একটি ইমরাত হয়তো পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে, কিন্তু কাজটা খুব তাড়াতাড়ি করা দরকার। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য ঝুঁকির তালিকা যেকোনোভাবেই হোক, এখন থেকে এক মাসের মধ্যে করে ফেলতে হবে। যাতে বসতিরা জানতে পারেন যে বর্ষায় তাঁদের বাড়িঘর স্থাপনায় থাকা যাবে না। আপাতত প্রাণ বাঁচানোর জন্য ন্যূনতম এই কাজগুলো করা প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের মধ্যে একটা নগর-পরিকল্পনা এবং নগরের ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ও নির্দেশিকা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। গত জুনের ধসের আগে ঝুঁকিতে থাকা বসতি বা স্থাপনার কোনো তালিকা রাঙামাটি প্রশাসন কেন, তিন পার্বত্য জেলার কারও কাছেই ছিল না। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক কথা হয়েছে, তারপর প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে, এখনো সে তালিকার কোনো হদিস নেই।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় রাঙামাটি পৌরসভা একটা সার্বিক নগর-পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পৌর নগর-পরিকল্পনাবিদ সুবর্ণ চাকমা। তিনি আশা করছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হবে, সেখানে শহরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার সবিস্তার বয়ান থাকবে। সেই পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই এগোবে আগামীর রাঙামাটি শহর।
এই পরিকল্পনা তখনই সহজ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, যখন এই পরিকল্পনা মানুষ নিজেদের তৈরি একটি পরিকল্পনা বলে মনে করবে, যখন মানুষ হবে এর স্বত্বাধিকারী-পৌর কর্তৃপক্ষ নয়। সেটা কীভাবে সম্ভব-জনগণকে, নগরবাসীকে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এককথায় তাঁদের কথা শুনতে হবে। যেটা শোনা যাবে না, সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে।
জনমানুষকে সম্পৃক্ত করার কোনো প্রক্রিয়া আমাদের কর্মকৌশলে থাকে না। জনগণকে সম্পৃক্ত না করার সংস্কৃতির চর্চার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ভূমিধসের কারণ খোঁজা কমিটি। ২৭ জনের এই বিশাল কমিটিতে অনেকেই আছেন, শুধু নেই যাঁদের জন্য এই কমিটি-পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কোনো প্রতিনিধি এখানে নেই।
কমিটির কাজ শুরুর কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হলেও কত দিনের মধ্যে এই কর্মযজ্ঞ শেষ হবে, তার কোনো দিনক্ষণ ছিল না। মানুষ কবে হাতে পাবে সেই প্রতিবেদন? এই প্রতিবেদনও রাঙামাটি শহর পরিকল্পনার জন্য খুবই জরুরি।
জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান আমাদের রাঙামাটি প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, ঝুঁকিতে থাকা রাঙামাটি শহর রক্ষার জন্য এ মুহূর্তে জেলা প্রশাসনের কাছে তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে শহর রক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে।
কেন এই ধস?
কমিটির কতিপয় সদস্যের উপস্থিতিতে গত ২১ আগস্ট ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলা হয়, ধসের কারণ বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিত আবাসন ও জলনিকাশের অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত জুম চাষ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি। এই আলোচনায় ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশনও দেওয়া হয়। বলা হয়, আগাম সতর্কসংকেতের ব্যবস্থা করতে হবে, পাহাড় উপযোগী গৃহনির্মাণ নীতিমালা থাকতে হবে, পর্যাপ্ত আশ্রয়ণের ব্যবস্থা, ভূমি ব্যবহার নীতিমালা আর সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। দেশের প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন আখতার অন্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ‘পাহাড়ে অবকাঠামো নির্মাণের সময় আমরা পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং এর সহ্যক্ষমতাকে আমলে নিচ্ছি না বলেই এই বিপর্যয়।’ তাঁর মতে, ‘আমাদের পাহাড়গুলো হয় উত্তর-দক্ষিণ অথবা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বেশির ভাগ রাস্তা উত্তর-দক্ষিণমুখী করে নতিঢালের ওপর নির্মাণ করা এবং এর ওপর ভারী যানবাহন চলাচল করায় ভূমিধসের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ রাস্তার কাছাকাছি থাকতে চায়। তাই পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তার পাহাড় কেটে জনবসতি গড়ে উঠছে। ফলে ঢাল অস্থিতিশীল হয়ে ভূমিধসের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’
মানুষ যোগাযোগের সুবিধার জন্য রাস্তার কাছাকাছি থাকবে, এটাই নিয়ম। সে জন্য রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় রক্ষার জন্য রিটেনশন ওয়াল বা প্রতিরোধী দেয়াল বানাতে হবে। থাকতে হবে তারের জালের আচ্ছাদন, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আর পাহাড়ের মাটি ক্ষয়রোধী বনায়ন। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলকথা, পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন বিশ্লেষণ না করে সমতলের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
মনোঘর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বাড়ির ওপর পাহাড়ের যে অংশ ভেঙে পড়েছে, সেটা রাস্তার পাশে অপরিকল্পিত নির্মাণের জন্যই হয়েছে। প্রধান শিক্ষক জিমিত চাকমা ভুল গাছ লাগানোর কথাও জানিয়েছেন। তাঁর মতে, পাহাড়ে থাকবে পাহাড়ের গাছ, এখানে থাকবে মদন মস্তো, শিলকড়ই, গোদা, চাপালিশ, জারুল, চাঁপা-এসব গাছ। যেখানে পাহাড়ি গাছ কেটে বন পরিষ্কার করে সেগুনের চাষ হয়েছে, সেখানে পাহাড় ধসে পড়েছে। পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি দূরের মিজোরাম দেখালেন। বললেন, ‘এখানে যখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে, তখন ওখানেও বৃষ্টি হয়েছে। সে বৃষ্টিতে আমরা ধসলাম, ওরা কেন দাঁড়িয়ে আছে? ওরা পাহাড়কে চিনেছে, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিয়ে কোনো বিবাদে যায়নি। আমরা পাহাড়কে সমতল বানানোর যুদ্ধে নেমেছি। ভুল করেছি, ভুল হচ্ছে। এখনো সময় আছে।’
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য এবং রাঙামাটি শহরের বাসিন্দা নিরুপা চাকমার মতে, রাঙামাটি শহর রক্ষা করতে হলে প্রশাসনের সব স্তর আর স্থানীয় সরকার তথা জেলা পরিষদের মধ্যে সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য জেলা পরিষদের প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। তা ছাড়া তাদের ওপর নানা অন্যায্য চাপ সব সময় থাকে।