ঢাকায় নির্বাচনের হাওয়া
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও প্রাথমিক তৎপরতা শুরু করেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের সবুজ সংকেত পেয়ে ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম মাঠে নেমে গেছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এখনো মাঠে না নামলেও ভেতরে-ভেতরে ভোটের কৌশল নিয়ে কাজ করছে দলটি।
আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভোট গ্রহণের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গতকাল মঙ্গলবার তিনটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এই বৈঠকে ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারির এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়।
গতকাল ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। ভোট গ্রহণ করা হবে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। ২৪ তারিখের পর যেকোনো দিন এ নির্বাচনের তারিখ হতে পারে। কমিশন বৈঠকে এটি ঠিক করা হবে।
ইসি সূত্র বলছে, উত্তর সিটিতে মেয়র পদে উপনির্বাচনের পাশাপাশি ওই সিটিতে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ছয়টি নারী কাউন্সিলর পদে ভোট গ্রহণ হবে। একই দিন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া সমপরিমাণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর পদে ভোট গ্রহণ হবে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রথমবারের মতো মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা রকিব উদ্দীন মণ্ডল বলেন, তাঁরা নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণের গেজেট হয়েছে। ভোটার তালিকাও চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী ৩১ জানুয়ারি হালনাগাদ তালিকা প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর প্রস্তুতি চূড়ান্ত হবে।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী। তিনি গতকাল মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া এলাকা হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, ভাটারা এলাকা ঘুরেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এসব এলাকায় ভোটার প্রায় আট লাখ। এর আগে তিনি নির্বাচনী এলাকার আটজন সাংসদের মধ্যে পাঁচজনের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছেন। এর বাইরে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন আতিকুল ইসলাম।
আতিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি, দলের নেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন তিনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গেও বসবেন। দল থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলেই পুরোদমে প্রচারে নামবেন।
আনিসুল হক মারা যাওয়ার পরপরই মেয়র পদে লড়ার জন্য পোস্টার ছাপিয়ে ও গণমাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী নেতা, রাজনীতিক, সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিরাও আছেন। তবে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন আতিকুল ইসলাম। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী কাজ শুরুর নির্দেশ দেন বলে জানা যায়। গত শনিবার দলের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকেও ডিএনসিসির প্রার্থী নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানেও আতিকুল ইসলামের বিষয়ে আলোচনা হয়। এরপর থেকে অন্যদের দৌড়ঝাঁপ কমে যায়।
এদিকে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এখনো মাঠে নামেনি, তবে ভেতরে-ভেতরে ভোটের কৌশল নিয়ে কাজ করছেন দলটির নেতারা।
বিএনপি সূত্র জানায়, গতবারের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবারও দলের প্রার্থী হিসেবে এখন পর্যন্ত বিবেচনায় আছেন। এর বাইরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে ও জোটের শরিক আন্দালিব রহমানকে কেউ কেউ বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আনছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি ইতিপূর্বে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ডিএনসিসিতেও অংশ নেবে। প্রার্থী নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। তবে এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলটির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, সরকারি দল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণার আগে বিএনপি প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে না। আর নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাবে না। সরকার নির্বাচন নিয়ে কতটা আগ্রহী, তা নিয়ে সন্দেহ আছে দলটির। আইনি জটিলতার সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে মাঠে নামিয়ে নির্বাচন আটকে দেওয়াও হতে পারে বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা।
এদিকে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ডিএনসিসিতে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যান্ড মাইলসের শাফিন আহমেদ। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) নামের একটি দল তাঁকে প্রার্থী করবে বলে তিনি জানান। তবে নির্বাচন কমিশনে এই দলের নিবন্ধন নেই, তাই তাঁকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই ভোটে অংশ নিতে হবে।
ডিএনসিসির গত নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন ১২ জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনিসুল হক ৪ লাখ ৬০ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তাবিথ আউয়াল পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ভোট। অবশ্য জবরদস্তি ও জাল ভোটের অভিযোগ এনে বিএনপির প্রার্থী দুপুরের পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন বাম গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতা জোনায়েদ সাকি। এবার সাকির প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢাকায় নির্বাচনের হাওয়া বইছে, এটা ঠিক। বিপরীতে নির্বাচন নিয়ে শুধু জটিলতা নয়, মামলা-মোকদ্দমার পাঁয়তারা শোনা যাচ্ছে। এখন নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যমান তোড়জোড় আছে, কিন্তু আড়ালে কী হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সব সংশয় দূর করে নির্বাচনটা করা গেলে কার কী জনপ্রিয়তা, এর একটা চিত্র বেরিয়ে আসবে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটা একটা পরীক্ষাই হবে।
আইনি মারপ্যাঁচ কি বাধা?
নির্বাচন কমিশন বলছে, যাঁরা এবার নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁরা এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু প্রার্থী হতে পারবেন না। কারণ, ৩১ জানুয়ারি হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের আগেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে কোনো নাগরিকের বয়স ন্যূনতম ২৫ বছর হতে হয়। ভোটার হওয়ার বয়স ১৮। কিন্তু ১৮ বছরের বেশি হলেও যে কেউ আগে ভোটার না হয়ে থাকলে যেকোনো সময় ভোটার হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার আশঙ্কা আছে।
আবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলর যাঁরা হবেন, তাঁদের মেয়াদ কত দিন হবে, তা আইনে উল্লেখ নেই। চলমান সিটি করপোরেশনের মধ্যমেয়াদে এসে এসব ওয়ার্ডে নির্বাচন করতে যাচ্ছে ইসি। ইসি বলছে, যেদিন করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হবে, সেদিন নতুন ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরদের মেয়াদও শেষ হবে। তবে ইসির কর্মকর্তাদের অনেকের আশঙ্কা, এতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, জটিলতা থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এই নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করা হতো না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্নগুলো আছে, মেয়র পদের উপনির্বাচনে নতুন ১৮ ওয়ার্ডের ভোটারেরা ভোট দেবেন কি না, উত্তর-দক্ষিণের নতুন ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরদের মেয়াদ কত দিন হবে, এগুলো আগেই সমাধান করে ফেলা ভালো। প্রয়োজনে আইন সংশোধন বা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা যায়। তবে নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত।