হাঁড়িতে চড়ার সময় ফেরত দুম্বার মাংস !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বছরের এদিনটির অপেক্ষায় থাকেন সবাই। দুম্বার মাংস রান্না হবে। তাই বাড়িতে উৎসবের আমেজ। রান্নাঘরে মাংস রান্নার প্রস্তুতি চলছে। কেউ মসলা বাটছেন। কেউ মাংস কেটে-ধুয়ে রান্নার উপযোগী করছেন। দুপুরে হঠাৎ খবর এল মাংস ফেরত দিতে হবে। প্রশাসনিক প্রবল চাপ। অগত্যা দুম্বার মাংস রান্না ‘গুড়ে বালি’। ধুয়ে-কুটে রান্নার উপযোগী করা মাংসই ফেরত দিলেন যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী।
ঘটনাটি মাগুরার মহম্মদপুরের। সৌদি আরব থেকে অসহায় দুস্থ মানুষের জন্য পাঠানো ওই দুম্বার মাংস সকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা, সাংবাদিক ও কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়ে। পরে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে দুপুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই মাংস ফেরত আনা হয়। ইউএনওর অনুরোধে অনেকে মাংস ফেরত দেন। পরে ওই মাংস গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রিত দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সৌদি সরকার প্রতিবছরের এ সময়ে দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য দুম্বার মাংস পাঠায়। সেখানে ঈদুল আজহার সময় ওই দুম্বাগুলো কোরবানি করা হয়। সরকার দেশের প্রতিটি জেলায় দুম্বার এই মাংস বণ্টন করে। এ বছর মাগুরার জন্য ২৬০ কার্টন (প্রতি কার্টনে ১০ কেজি) মাংস আসে। এগুলো মাগুরা সদরে ৭০ কার্টন, শ্রীপুরে ৭৮ কার্টন, শালিখায় ৪৯ কার্টন ও মহম্মদপুরে ৬৩ কার্টন বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি উপজেলায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দুম্বার ওই মাংস বিতরণের ব্যবস্থা করেন ইউএনওরা। কিন্তু মহম্মদপুর উপজেলায় দুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে মাংস বিতরণ না করে ওই মাংস স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, স্থানীয় প্রেসক্লাবসহ কিছু সরকারি কর্মকর্তার মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেন ইউএনও। কাকে কাকে দেওয়া হবে, এ জন্য তিনি একটি তালিকাও তৈরি করেন। বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়ে। পরে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে ওই মাংস প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং অনুরোধ করে ফেরত আনেন ইউএনও। পরে তা স্থানীয় গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রিত গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
সূত্র জানায়, দুম্বা নেওয়ার ওই তালিকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদুজ্জামান, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শামসুর রহমান, উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ঈদুল শেখ, উপজেলা যুব মহিলা লীগের নেত্রী শারমিন আক্তারসহ অনেকে ছিলেন।
জানতে চাইলে মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, ‘এ দেশে দুম্বার মাংস পাওয়া যায় না। তাই দুম্বার মাংস নিয়ে মনে একটা কিউরিসিটি জাগে। তবে আমি নিইনি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেপেলেরা নিছিল। তারপর ফেরত দেছে। আমার নাম আসছে শুনলাম। কিন্তু নিইনি। এমনকি মহম্মদপুরে ছিলামই না। সব হয়েছে ফোনে ফোনে। আমি ইউএনওকে বলেছি, আমাকে বেচলেন কেন?’
জিজ্ঞেস করা হলে মহম্মদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ঈদুল শেখ বলেন, ‘আমি বা ছাত্রলীগের নামে দুম্বার মাংস দেওয়া হয়নি।’
তবে মহম্মদপুর যুব মহিলা লীগের নেত্রী শারমিন আক্তার দুম্বার মাংস নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ওই মাংস ফেরত দেওয়া হয়েছে। ইউএনও সাহেব খুউব সুন্দরভাবে গরিবদের মাঝে সেগুলো বণ্টন করেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি।’
জানতে চাইলে মহম্মদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও মহম্মদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কামরুল হাসান বলেন, ‘দুম্বার মাংস আমাদের দেওয়ার কথা ছিল। আনতে বলেছিল। কিন্তু আমরা নিইনি। কেউ আনতে যাইনি।’
মহম্মদপুর সদর ইউনিয়নের (ইউপি) ৩, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নওশের আলী, লিটন শেখ ও হাবিবুর রহমান কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গরিব-মিসকিনদের দুম্বার মাংস নেতা আর সরকারি কর্মকর্তারা মেরে খায়। তাদের বিবেক নেই। লজ্জা-শরমও নেই। অথচ আমরা জনপ্রতিনিধি হয়ে এর কিছুই জানি না। গরিব মানুষ দুম্বার মাংসের জন্য আমাদের কাছে ধরনা দেয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাংস বিলির পর তা নেতাদের কাছ থেকে ফেরত আনা মুশকিল। জেলা প্রশাসকের চাপে ইউএনও কিছু মাংস ফেরত এনেছেন। তবে তার পরিমাণ খুবই সামান্য। অনেকে রান্নাবান্না করে ফেলেছেন। আবার অনেকে ফেরত দেননি।’
ইউএনও মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, ‘যাঁদের মাংস দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে ফেরত এনে অসহায়-দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আমার বাসায় নয়, সকালে ওই মাংস অফিসার্স ক্লাবে রেখে সেখান থেকে বিতরণ করা হয়েছিল।’
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। মিসকিনদের মাংস কেউ রান্না করে খেতে পারে? ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় এবং নানাভাবে আমি বিষয়টি জানার পর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি। যাঁরা মাংস নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে মাংস ফেরত এনে দুপুরেই দুস্থদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেছি। চার উপজেলার মধ্যে শুধু মহম্মদপুরেই এমন সমস্যা হয়েছে। ইউএনও অন্যায় করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’