ছাত্রলীগের ভয়ে ক্যাম্পাসে যান না বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হুমকির কারণে প্রায় দুই মাস ধরে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে পারছেন না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ আমির উদ্দিন। ভয়ে তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রস্তাবিত হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) প্রত্যাহারের দাবিতে কয়েক মাস আগে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন এই শিক্ষক।
আমির উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহযোগী অধ্যাপক। গত ৬ নভেম্বর থেকে তিনি ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন না। এর আগের দিন তাঁর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ছাত্রলীগের একপক্ষের নেতা-কর্মীরা হুমকি দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা ক্যাম্পাসে তাঁর নিজের কার্যালয়েই ঘটে। সেদিনই চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হুমকি এবং তাঁকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকেও লিখিতভাবে জানান।
চট্টগ্রাম শহরে গৃহকর প্রত্যাহারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমির উদ্দিনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণের দাবি তুলে গত ৭ নভেম্বর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগ। তাঁর নিয়োগকে অবৈধ উল্লেখ করে সেদিন উপাচার্যকে স্মারকলিপিও দেন নেতা-কর্মীরা।
হুমকি দেওয়ার ঘটনায় কোনে ব্যবস্থা না নিয়ে এখন উল্টো মেয়রের অনুসারী ছাত্রলীগের করা বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে শিক্ষক আমির উদ্দিনকে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২৪ ডিসেম্বর দেওয়া চিঠির জবাব আগামী ৪ জানুয়ারির মধ্যে লিখিতভাবে জমা দিতে বলা হয়েছে তাঁকে। এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে দায়িত্ব পালন করা জ্যেষ্ঠ পাঁচজন শিক্ষক। তাঁরা বলেন, একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কোনো ছাত্রসংগঠন অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষককে জবাব দেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষককে অসম্মান করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. হাছান মিয়া স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত সৃষ্ট ও বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করার জন্য উপাচার্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। আপনার (আমির উদ্দিন) বিরুদ্ধে আনা ছাত্রলীগের সভাপতির অভিযোগগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য এই কমিটিকে অনুরোধ করা হয়।’ চিঠিতে অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য লিখিতভাবে আগামী ৪ জানুয়ারির মধ্যে কমিটির সচিবকে দেওয়ার জন্য আমির উদ্দিনকে অনুরোধ করা হয়।
আইইআরের পরিচালক এম এ শাহেন শাহ বলেন, আমির উদ্দিনকে হুমকি দেওয়ার সময় তিনি পরিচালক ছিলেন না। তবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি মুঠোফোনে আমিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিরাপত্তার কারণে ইনস্টিটিউটে আসতে না পারার বিষয়টি আমির তাঁকে জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর সিটি করপোরেশন দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতির (স্থাপনার বর্গফুটের ভিত্তিতে) পরিবর্তে ভাড়ার ভিত্তিতে কর পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। এতে গৃহকর ‘অসহনীয়ভাবে’ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা বাতিলের দাবিতে নগরে সভা-সমাবেশ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ঘেরাওসহ বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ আমির উদ্দিন। গত ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ দেশের সব সিটি করপোরেশনের গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গৃহকর নিয়ে আন্দোলন করার কারণে যদি আমির উদ্দিনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। করদাতা যে কেউ করের বিষয়ে আপত্তি করার অধিকার রাখেন। আমির যা করেছেন নাগরিক হিসেবে তাঁর পুরোপুরি অধিকার রয়েছে।’
শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় এখনো তদন্ত চলছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর লিটন মিত্র। তিনি বলেন, সহযোগী অধ্যাপক আমির উদ্দিন নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পাসে আসতে পারছেন না, এটি তাঁরা জানেন না।
শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবু তোরাব বলেন, ‘তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কীভাবে আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিরূপ মন্তব্য করেন? আর তিনি আমাদের নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীনের নামে অশালীন মন্তব্য করেছেন। এখন নিজেই বক্তব্য দিয়ে নিজে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে।’
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হুমকির বিষয়ে শিক্ষক আমির উদ্দিন বলেন, ‘আমার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে যাঁরা হুমকি দিয়েছেন তাঁরা উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুরেও ছিলেন। পরে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ (ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী) হত্যা মামলার আসামি। বিভিন্ন ঘটনার পরও তাঁরা ক্যাম্পাসে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় আমি কীভাবে ক্যাম্পাসে যাব?’
ছাত্রলীগের অভিযোগের বিষয়ে আমির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলাম, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জানা আছে। ছাত্রলীগের অভিযোগের জবাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে। আমি কেন দেব?’