ইরানে আবার বিপ্লব
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নতুন বছরের শুরুটা ইরানের জন্য ভালো হলো না। গত বৃহস্পতিবার থেকে বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করছে দেশটির সাধারণ মানুষ। প্রথমে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল ছোট ছোট জটলা থেকে। এখন তা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। আর শাসকগোষ্ঠীর গদি নড়ে উঠছে। একই সঙ্গে ইরানের অভ্যন্তরীণ এই সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরু হয়ে গেছে কথার লড়াই।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতির অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইরানে। এর লক্ষ্য ক্ষমতাসীন ধর্মীয় নেতারা। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রথম বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে মিছিল হয়। এরপর খোরামাবাদ, ঝানজান, আহভাজ, তেহরান প্রভৃতি শহরে বিক্ষোভ থেকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়। আবহার শহরে আয়াতুল্লাহ আল খামেনির ছবিসংবলিত বড় বড় ব্যানারে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে আন্দোলন ক্রমে সহিংস হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন শহরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ভিডিও চিত্রে এসব দেখা গেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন নিশ্চিত করেছে, ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় গত রোববার রাতেই ১০ জন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে মোট নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১২-তে দাঁড়াল। এ ছাড়া বিক্ষোভের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এরই মধ্যে কড়া ভাষায় সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। গত রোববার তিনি বলেন, জনগণের সরকারের সমালোচনা করার অধিকার থাকলেও দেশের সম্পদ ধ্বংস করার অধিকার নেই। কোনো ধরনের সহিংসতা সহ্য করা হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন রুহানি। আর রুহানির পথেই হাঁটছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী। বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, এই বাহিনী বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করার কথা জানিয়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পেছনে বিদেশি শক্তির ইন্ধন আছে বলে মনে করছে রেভল্যুশনারি গার্ড।
বিক্ষোভ দমনে গত শনিবার রাতে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করা হয় কিছুক্ষণের জন্য। আর রোববার থেকে মোবাইল ফোনে ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইরানি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে বিক্ষোভকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। আর এই উসকানির অধিকাংশই আসছে সৌদি আরব ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
নতুন বিপ্লব?
ইরানের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ, দেশটিতে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রবেশাধিকার অবাধ ও স্বাধীন নয়। বিশেষ করে বিক্ষোভ উত্তাল এলাকাগুলোতে আরও সীমিত। ফলে বর্তমান পরিস্থিতির নিখুঁত চিত্রটি তুলে ধরা একটু কঠিন।
বিবিসির পারসিয়ান বিভাগের বিশ্লেষক কাসরা নাজি বলেছেন, দিন দিন ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্তে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের তুলনায় ইরানি নাগরিকেরা ১৫ শতাংশ বেশি দরিদ্র হয়েছেন। এখন পর্যন্ত বিক্ষোভে তরুণ পুরুষদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা যাচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা কট্টরপন্থী শাসনব্যবস্থার অবসান দাবি করছে। ধীরে ধীরে ইরানের ছোট ছোট শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এই বিক্ষোভের কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্ব নেই।
কাসরা নাজি আরও বলেন, ইরানে বর্তমানে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। বেশির ভাগ বিরোধীদলীয় নেতাকেই হয় নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, না হয় মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ নির্বাসিত রাজপরিবারের পুনর্বাসনের দাবিও করছে। কিন্তু এই বিক্ষোভ আসলেই কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে পূর্বানুমান করা বেশ কঠিন।
২০০৯ সালে কী হয়েছিল? এর আগে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছিল ২০০৯ সালে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে রাজশাসনের অবসানের পর ২০০৯ সালেই প্রথম বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছিল দেশটিতে। ওই বিক্ষোভকে গ্রিন মুভমেন্ট বা সবুজ আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়। ওই সময়ের নির্বাচনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের বিতর্কিত বিজয়ের প্রতিবাদে বিরোধীদলীয় সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেই বিক্ষোভে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছিল। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাজারো বিক্ষোভকারীকে।
ইরানের সংস্কারপন্থী গণমাধ্যম নাজারের প্রধান সম্পাদক পায়াম পারহিজ মনে করেন, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালের বিক্ষোভ অনেক দিক থেকে আলাদা। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের বিক্ষোভ ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। আর এখনকার বিক্ষোভ মূলত অর্থনৈতিক সংকটকেন্দ্রিক। ধীরে ধীরে এটি রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছে।
পায়াম পারহিজ বলেন, ‘এবার তাঁদের মূল চিন্তা অর্থ নিয়ে। অর্থনৈতিক সংকটে মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই লোকগুলো সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করা অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সমস্যার সমাধান না হবে, ততক্ষণ তারা রাস্তা ছেড়ে যাবে না।’
২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাসান রুহানি দেশটির ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্লেষকদের বক্তব্য, এই উন্নয়নের গতি খুবই ধীর। বর্তমানে ইরানে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ। দারিদ্র্যের হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।
সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তাঁদের দেওয়া স্লোগানগুলো এমন: ‘রুহানির মৃত্যু হোক’, ‘ফিলিস্তিন ভুলে যান’, ‘গাজা নয়, লেবানন নয়, আমার জীবন ইরানের জন্য’ ইত্যাদি। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা নিয়ে বিক্ষোভকারীরা খুব একটা খুশি নয়। অন্য দেশের চেয়ে নিজেদের নিয়েই এখন ভাবতে চায় তারা।
ব্রুকিংস দোহা সেন্টারের ভিজিটিং ফেলো আলি ফাথোল্লাহ-নেজাদ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘রুহানির অর্থনৈতিক নীতি ব্যর্থ হওয়ায় মানুষের মনে ক্ষোভ গড়ে উঠেছিল। এখন এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আবার রাজনৈতিক নিপীড়নের দিক থেকেও কোনো উন্নতি হয়নি। সুতরাং মানুষের যে ক্ষোভ এখন দেখা যাচ্ছে, সেটি একদিকে আর্থসামাজিক, অন্যদিকে রাজনৈতিক।’
ইরানওয়্যার ডটকমের সম্পাদক মাজিয়ার বাহারি অবশ্য এখনই এই বিক্ষোভকে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করতে চান না। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের প্রতি ইরানের সরকারের সমর্থনকে অপ্রয়োজনীয় ও কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বলে মনে করে দেশটির অনেক নাগরিক। গত ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রুহানি বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন এবং তাতে সাধারণ নাগরিকের জীবন আরও ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। চলমান বিক্ষোভে কট্টরপন্থী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি ও তথাকথিত ‘কিছুটা সংস্কারপন্থী’ হাসান রুহানির শাসনের প্রতি সাধারণ নাগরিকের অসন্তুষ্টি প্রকাশিত হয়েছে।
কী হবে?
ইরানে বিক্ষোভের সূচনা হওয়া মাত্রই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লাগাতার টুইট করে চলেছেন। তিনি বলেছেন, জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়। এমন দিন আসছে, যখন ইরানের জনগণের সামনে বেছে নেওয়ার মতো সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইরানি মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী শিরিন এবাদি তো বলেই দিয়েছেন, ইরানে চলমান বিক্ষোভ বড় ধরনের আন্দোলনের সূচনা মাত্র।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ধারণার চেয়েও দ্রুতগতিতে ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। ইরানের সাংবাদিক নেগার মোরতাজাভি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন ও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে স্লোগানের বাইরে আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। বিক্ষোভ কিন্তু প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ নেতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই বিষয়টিই উদ্বেগের।’
মাজিয়ার বাহারি ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, দেশটির বর্তমান প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে’ উৎখাত করা এত সহজ নয়। বর্তমান সরকার এই ‘নেতৃত্বহীন’ বিক্ষোভকে বিদেশি শক্তির ইন্ধনে সৃষ্ট বলে দাবি করবে এবং একে আড়াল করতে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু ইরানের শাসকদেরও বুঝতে হবে যে বিদেশি শক্তি বা জায়নবাদীরা নয়, সরকারের ক্ষমতার মূল হুমকি ঘরেই আছে। আর সেটি হলো সাধারণ জনগণ।