ছাত্রলীগে ক্ষমতার লড়াই
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ছাত্রলীগের ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ কমিটির ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির নেতৃত্বের বিরোধ এবার প্রকাশ্যে এসেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ সম্মেলনের দাবি নিয়ে আজ বুধবার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে যাচ্ছে।
মাস ছয়েক আগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবন নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছিল। এ নিয়ে সে সময় সংগঠনের ভেতরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েন ওই শীর্ষ দুই নেতা। সংগঠনের ওই বিক্ষুব্ধ অংশটি এবার নতুন কমিটি চাইছে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এর আগেই ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ কমিটির সম্মেলনের ঘোষণা দাবি করে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল মঙ্গলবার সকালে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। কিন্তু সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) উপস্থিত হয়ে তাঁরা জানান, কর্মসূচিটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই আমরা সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় সম্মেলন দাবি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দলের (আওয়ামী লীগ) হাইকমান্ড থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁরা আমাদের দাবি শুনবেন এবং আমাদের কথা নেত্রীকে জানাবেন। আশা করছি, একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।’
ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান একাধিক নেতা বলছেন, মূলত সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন বলে অন্য পদগুলোর নেতারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের দামি গাড়িতে চড়া এবং বিলাসী ফ্ল্যাটে থাকায় তাঁদের অর্থের উৎস, সংগঠনের তহবিলে আসা অর্থ ও খরচের খাত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গত বছরের ১২ জুলাই ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে এসব অর্থের হিসাব চান। এমনকি তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ বা টেন্ডারবাজি করে টাকা উপার্জনের অভিযোগও উত্থাপন করেন। এক নেতা এসব টাকার ভাগও দাবি করেন। এ নিয়ে সভায় ব্যাপক হট্টগোল হয়। ওই বছরের শুরুতে ছাত্রলীগের সভাপতি হেলিকপ্টারে করে ঈশ্বরদীতে কর্মশালা ও সম্মেলনে যোগ দিতে গেলে নিজ সংগঠন ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েন।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ একটি ছাত্রসংগঠন হলেও এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ দুটি লাভজনক। ফলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা বছরের পর বছর দায়িত্ব ছাড়তে চান না। অন্য পদে থেকেও অনেকে অনেক অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান দাবি করেন, তাঁদের এক টাকাও উপার্জন নেই।
ছাত্রলীগের ১৯৯০ সাল-পরবর্তী কোনো কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই চার বছরের আগে ক্ষমতা ছাড়েননি। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৭০ বছরে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে ২৮ বার। এর মধ্যে গত ৩০ বছরে মাত্র ৭টি নতুন কমিটি পেয়েছে ছাত্রলীগ, যেখানে গঠনতন্ত্র মানলে অন্তত ১৫টি কমিটি হতো। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১(খ) ও (গ) ধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল দুই বছর। এর মধ্যে সম্মেলন না হলে সংসদের কার্যকারিতা থাকবে না। বিশেষ বা জরুরি পরিস্থিতিতে বর্ধিত সভায় অনুমোদনের মাধ্যমে কমিটি তিন মাসের জন্য সময় বাড়াতে পারে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই সাইফুর রহমানকে সভাপতি ও এস এম জাকির হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটির মেয়াদ দুই বছর শেষ করে আরও পাঁচ মাস পার হতে চললেও সম্মেলনের কোনো আলোচনা নেই। ফলে বর্তমান কমিটিও পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটবে বলে আশঙ্কা ছাত্রলীগ নেতাদের একাংশের। তাঁদের মধ্যে সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে সম্পাদক, উপসম্পাদক ও সহসম্পাদক পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা আছেন। তাঁদের বক্তব্য, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলে বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্মেলন বিলম্ব করতে চাইছেন। তাঁদের অনুসারীরা ছড়াচ্ছেন, নির্বাচনের আগে নতুন নেতৃত্ব এলে সারা দেশে কোন্দল বাড়তে পারে।
গত বছরের ১২ জুলাই সাধারণ সভায় হট্টগোলের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, খুব শিগগির ছাত্রলীগের সম্মেলনের খবর পাওয়া যাবে। গত নভেম্বরে ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে গিয়েও তিনি সম্মেলনের তাড়া দেন।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, ‘আমরা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত। নেত্রী যখনই বলবেন, তখনই সম্মেলন হবে। সেটা এক মাসের মধ্যেও হতে পারে, জাতীয় নির্বাচনের পরও হতে পারে।’ গঠনতন্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের জন্যই তো গঠনতন্ত্র। কখন সম্মেলন হলে ছাত্রলীগের ভালো হবে, সেটা নেত্রীই ভালো বলতে পারবেন।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বেহিসেবি নেতা
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগে কোনো তালিকা ছাড়াই গণহারে পদ দেওয়া শুরু করে ছাত্রলীগ। ২০ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন শাখার অন্তত ১৬২ জন নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সঙ্গে আপলোড করেন সভাপতি ও সম্পাদকের সই করা চিঠি। এর আগে আরও দুই দফায় কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেওয়া হয়।
ওই সময় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান বলেছিলেন, বিয়ে ও চাকরির কারণে অনেক পদ খালি হয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে কমিটির নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে।
সেই ‘দু-এক দিন’ শেষ হয়নি ছয় মাসেও। গতকাল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের কাছে নতুন তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো তালিকা করা হয়নি। সামনে কমিটি পুনর্গঠন করার চিন্তা আছে। তখন পাওয়া যাবে।
২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে উপসম্পাদক ও সদস্য পদের ২৬টি শূন্য রাখা হয়। শূন্যপদের বিপরীতে বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে সদস্য করা হয়। গত বছরের মে মাসে আবার কিছু পদ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার অভিযোগ, মেয়াদের শেষ পর্যায়ে যখন সম্মেলনের দাবি উঠতে শুরু করে, তখন সর্বশেষ গণহারে পদ দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে। এর আগেও অনেক কমিটি দুই বছরের বেশি ছিল। সেগুলো কি অবৈধ হয়ে গেছে? তিনি বলেন, ‘সম্মেলন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমাদের জেলা কমিটিগুলো হচ্ছে। এরপর কেন্দ্রীয় সম্মেলন হবে।’