নিজের ছকেই নেই নির্বাচন কমিশন
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের ঘোষণা করা কর্মপরিকল্পনা ঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত ডিসেম্বরের মধ্যে মোটা দাগে যে তিনটি কাজ করার কথা ছিল, সেগুলো শুরু হলেও শেষ হয়নি। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নতুন কমিশন গত ১৬ জুলাই নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সাতটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে ইসি। এগুলো হচ্ছে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচনপ্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়ানো।
এগুলোর মধ্যে গত ডিসেম্বরে তিনটি কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, এগুলোই ছিল কমিশনের মূল কাজ। কিন্তু ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ সময়ের মধ্যে আইন সংস্কারের খসড়া প্রস্তুত করার কথা ছিল, তা–ও চূড়ান্ত হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহে কিছু আইনি সংস্কারের খসড়া চূড়ান্ত হতে পারে। এ ছাড়া পরামর্শ নেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ে সংলাপ করতে পারলেও সুপারিশ চূড়ান্ত করে তা প্রকাশ করতে পারেনি ইসি।
ইসির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, আইন সংস্কার ও সীমানা নির্ধারণ—এই দুটি বিষয় নির্বাচনের আগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের যত আগে এই দুটি কাজ শেষ করা যাবে তত ভালো।
বাকি চারটি কাজের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার সময় ৩১ জানুয়ারি। ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজ আগামী জুন থেকে শুরু হওয়ার কথা। আর রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজ চলছে। নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে।
জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের সুপারিশ চূড়ান্ত হয়েছে। আইন সংস্কার ও সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে, শেষ হয়ে যাবে। কর্মপরিকল্পনার অন্য সব বিষয়ও নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে।
সীমানা নির্ধারণ পুরোনো আইনে
নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়েছিল ইসি। তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। ইসি বলেছিল, শুধু জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি না করে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা এবং সংসদীয় এলাকার আয়তন বিবেচনায় নিয়ে সীমানা নির্ধারণ করার জন্য আইনি কাঠামোতে সংস্কার আনা প্রয়োজন। রাজধানীর মতো বড় শহরের আসনসংখ্যা সীমিত করে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। এ জন্য নতুন একটি আইনের খসড়া করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ইসির উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, জুলাইয়ে এ–সংক্রান্ত আইনের একটি প্রাথমিক খসড়া করা হলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি। বিদ্যমান আইনেই সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে ইসি। নতুন আইন যদি করাও হয়, তা আগামী নির্বাচনের আগে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংসদীয় আসনে পরিবর্তন আনতে পারছে না ইসি।
ইসি কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল, জুলাই-আগস্ট থেকে কাজ শুরু করে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করবে। বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।
ইসির একজন কর্মকর্তা জানান, সীমানা নির্ধারণের কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। গত ডিসেম্বরে ইসি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে। সীমানা নির্ধারণ করে তার খসড়া তালিকা প্রকাশ করে দাবি, আপত্তি বা সুপারিশ আহ্বান, আপত্তির বিষয়ে অঞ্চলভিত্তিক শুনানি শেষে নিষ্পত্তি করার কাজ এখনো বাকি রয়েছে। এগুলোর পর সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হবে।
আইন সংস্কারের খসড়া হয়নি
ইসির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে আইন সংস্কারের প্রাসঙ্গিক খসড়া প্রস্তুত করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) বিভিন্ন ধারা সংশোধনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বেশ কিছু প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে ইসি ৩১টি ধারা সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ইসি এখনো খসড়া চূড়ান্ত করতে পারেনি। খসড়া করার পর কমিশনের সভায় অনুমোদন করা হলে তা চূড়ান্ত খসড়া বলে গণ্য হবে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা আছে ইসির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে তা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, ইসি খসড়া করার পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখানে ভেটিংয়ের পর তা উঠবে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে। তারপর উঠবে সংসদে। কমিশন সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহে আরপিও সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত হতে পারে। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
সংলাপের সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি
ইসি কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল, নির্বাচনপ্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে অক্টোবরের মধ্যে সংলাপ শেষ করবে। অক্টোবরের মধ্যে সংলাপ শেষ হয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে সংলাপের সুপারিশমালা চূড়ান্ত করার কথা বলেছিল। ইসি সূত্র জানায়, সংলাপের সুপারিশমালা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। ইসি ডিসেম্বরে সুপারিশগুলো বই আকারে প্রকাশ করে সব দলকে দেওয়ার কথা বলেছিল। এটাও হয়নি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সময়সীমা ঘোষণা করা হলে সেই সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা উচিত। সেটা করতে না পারলে কেন পারছে না, কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, থাকলে সেটা কী, এগুলো নির্বাচন কমিশনের পরিষ্কার করা উচিত। কারণ, মানুষ নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবন্ধন যাচাইয়ে ধীরগতি
ইসি কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত পালন করছে কি না, অক্টোবরের মধ্যে সেই তথ্য সংগ্রহ করা হবে। জানুয়ারির মধ্যে এসব তথ্য পর্যালোচনা করে নিবন্ধন বহাল রাখা না–রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রেও ইসির ধীরগতি দেখা গেছে। দলগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় গত নভেম্বরে। নতুন দল নিবন্ধনের কাজ চলমান রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাঁরা আগাম নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইসি পিছিয়ে আছে, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরগতি সেটাই প্রমাণ করে। তাঁর মতে, রংপুরে যে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, সেই অর্জন ধরে রাখতে হলে ইসিকে সার্বিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হতে হবে।