ঘন কুয়াশায় আতঙ্ক নয়

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বয়রাগাদি ইউনিয়নের ছোট গ্রাম পাউলাদিয়া। এ গ্রামের কৃষক আকতার হোসেন তালুকদারের প্রায় ১৩০ বিঘা জমির পুরোটাই এখন আলুর খেত। আলুগাছগুলো বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। তাঁর খেত থেকে এরই মধ্যে ঝুড়ি ভর্তি করে আলু তোলা শুরু হয়ে গেছে। লাভের আশায় দিন গুনছেন আকতার হোসেন।

কিন্তু কয়েক দিন ধরে আকতার হোসেনের কপালে ভাঁজ পড়েছে। কারণ এক দিন-দুদিন নয়, জানুয়ারিতে টানা ১২ দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। আছে কুয়াশা। আকতার হোসেনের আলুর বিশাল খেতও বিকেল হতে না হতেই ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে। এতে তাঁর ভয়ের বড় কারণ একটিই—ছত্রাকের আক্রমণে আলু পচে যায় কি না। তাই আকতার হোসেন ওষুধ ছেটাচ্ছেন আলুগাছে। এর সঙ্গে অন্যান্য পরিচর্যারও কমতি নেই।

পাউলাদিয়া গ্রামেরই আরেক আলুচাষি মো. ইয়াসিনের শঙ্কা—শীতের তীব্রতা আরও বাড়লে আলু পচে যেতে পারে। তাই আকতার ও ইয়াসিন ছত্রাকনাশক পাউডার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন আলুগাছে।

তবে আকতার-ইয়াসিনের মতো মুন্সিগঞ্জের হাজারো আলুচাষিকে আশার কথাই শোনাচ্ছে জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এই কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, এখন যে মাত্রার শীত পড়ছে, তা আলু চাষের জন্য উপযুক্ত। তবে কুয়াশা পড়লে ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬ লাখ মেট্রিক টন। তবে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন বাড়লেও আলুর মড়ক লাগার শঙ্কা আতঙ্কে রাখে চাষিদের। ঘন কুয়াশায় তাঁদের এই আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।

কৃষিবিদদের মতে, আলুর বিপদ নিয়ে আসে মড়ক রোগ (লেইট ব্লাইট)। ঘন কুয়াশা পড়লে এই রোগের আক্রমণ হতে পারে। নিয়ম মানলে এই মড়ক থেকে আলুগাছ রক্ষা করা যায়। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) থেকে জানা গেছে, মড়ক রোগে আক্রান্ত হলে আলুগাছে বর্দোমিক্সচার অথবা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে মিশিয়ে সাত দিন পরপর ছেটাতে হবে। এ ছাড়া এই রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত গাছটি তুলে মাটিচাপা কিংবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে পানি সেচ বন্ধ রাখতে হবে। আরেকটি সুস্বাদু সবজি টমেটোরও এই রোগ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

আলু উৎপাদন করে কৃষকেরা শুরু করেন রবি ফসল বোরো ধানের চাষ। তবে এর প্রস্তুতি শীতকালেই নিতে হয়। এ সময় বীজতলা তৈরি করে থাকেন কৃষকেরা। তবে শীতের তীব্রতা বাড়লে তাঁরাও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।

এআইএসের তথ্য অনুযায়ী, বীজতলায় ১ থেকে ২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহের সময় এই বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। সকালবেলা বীজতলার পানি বের করে নতুন করে পানি দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে রশি দিয়ে টেনে চারা থেকে কুয়াশার পানি ঝেড়ে ফেলতে হবে। ঠান্ডায় চারা ধসে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় বোরোর বীজতলা থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে হয়েছে। চারা রোপণের সময় শৈত্যপ্রবাহ থাকলে কয়েক দিন দেরি করে সেটি করতে হবে। ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সী বোরো চারা রোপণ করতে হবে। এই বয়সী চারা কম মরে ও সতেজ থাকে। এ ছাড়া উৎপাদন বেশি হয়। থোড় ও ফুল ফোটার সময় আবহাওয়া অতিরিক্ত ঠান্ডা থাকলে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হয়। এর ফলে থোড় সহজে বের হয়। এই ধানে চিটা কম পড়ে।

ঠান্ডা সহনশীল ধান বি-৩৬ এ ব্রি-৫৫ ধান চাষ করলে চারা কম মারা যায়। তাই শীতকালে এ জাতের ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

জানুয়ারি মাসের এই সময় থেকে আমগাছে প্রচুর মুকুল ধরে। কিন্তু ঘন কুয়াশা পড়লে এই মুকুল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন আবহাওয়ায় প্রতিরোধক হিসেবে বর্দোমিক্সচার অথবা সালফার জাতীয় কীটনাশক এক লিটার পানিতে দুই গ্রাম করে মিশিয়ে আমগাছে ব্যবহার করতে হবে।

এবারের টানা শৈত্যপ্রবাহে রবি ফসল উৎপাদনে সমস্যা হবে না বলে মনে করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ জন্য তাদের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকটি দল উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (সরেজমিন) মো. আবদুল হান্নান বলেন, প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা কয়েক দিন পড়লেও তাপমাত্রা কিন্তু বাড়ছে। এর সঙ্গে রোদও আছে। তাই বোরো ধান চাষে কোনো সমস্যা হবে না। তবে এ সময় সন্ধ্যার পর বোরোর বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা খুব প্রয়োজন। শীত বেশি পড়লে আলু বা অন্যান্য সবজি চাষও বিঘ্ন হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ