ফারিয়ার বক্তব্য নিয়ে যা বললেন তাঁরা

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ‘কাস্টিং কাউচ’ নিয়ে হলিউড ও বলিউডে এখন জোর আলোচনা। সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মডেল ও অভিনয়শিল্পী ফারিয়া শাহরিনের কথায়ও উঠে এসেছে বাংলাদেশে কাস্টিং কাউচের একটা চিত্র। অভিনয় আর মডেলিং করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলার পর ২০০৭ সালে ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতার রানারআপ ফারিয়ার ওপর চটেছেন কেউ কেউ। এঁদের মধ্যে অভিনয়শিল্পী যেমন আছেন, তেমনি আছেন কয়েকজন প্রযোজক, পরিচালক। তাঁদের মতে, কাস্টিং কাউচ নিয়ে ফারিয়া যা বলেছেন, তা মোটেও ঠিক না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্নজন নানা মন্তব্য করেছেন।

‘সরাসরি বলেছে, কত টাকা হলে আপনি যাবেন?’ শিরোনামের ফারিয়া শাহরিনের এই সাক্ষাৎকার অনেকের কাছে প্রশংসিত হলেও কিছু অভিনয়শিল্পী, পরিচালক আর প্রযোজক বেশ চটেছেন। ফারিয়ার মতে, ‘আমি তো আমার অভিজ্ঞতা বলে রীতিমতো তোপের মুখে পড়েছি। সত্য বলাটা কি তাহলে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল? আমি শঙ্কিত।’

ফারিয়ার সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর এ নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনয়শিল্পী সংঘের অনুষ্ঠান সম্পাদক বন্যা মির্জা। তিনি ফারিয়াকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘কে ইনি? কী করেন? অভিনয়? লাক্স সুপারস্টার? এই অবস্থা কেন? ওনাকে সাহায্য করতে হবে যাতে কিছু কাজ পান। ঠিকঠাক কাজ। মানে অভিনয়। বেচারা তো খুব বিপদে আছে। কিছু কাজ পেলে কেউ আর এমন বলতে পারবে না। আহারে…খুব মায়া লাগছে। সবার উচিত তাঁকে সাহায্য করা। কী যেন নাম? আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। দেখি কার এত সাহস। ইশ্‌ মেয়েটা। মায়া লাগছে খুব।’

ফারিয়াও কম যান না। জ্যেষ্ঠ শিল্পী বন্যা মির্জার কাছ থেকে এমন মন্তব্য পাওয়ার পর তার পাল্টা জবাব দিয়েছেন। বন্যা মির্জাকে সালাম দিয়ে ফারিয়া লিখেছেন, ‘আপনি আমাকে না-ই চিনতে পারেন। কারণ, আপনি আমার অনেক সিনিয়র। আমি আপনাকে চিনি। আর আপনাকে চিনি বলেই আমার আফসোস নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমি খুব বিপদে নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাকে খুব ভালো রাখছেন। মিডিয়াকে ভালোবেসে আমি সুস্থভাবে কাজ করতে চাই। নির্মাতাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করে “শুধু বন্ধু” বলতে পারি না, আপনারা যাদের সঙ্গে চলাফেরা করেন। আপনি আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন, শুকরিয়া। কিন্তু আপনার সাহায্য আমার লাগবে না, আপু। মিডিয়াতে কাজ করে আমি ভাত খাই না। তবে মিডিয়ায় কাজ করে দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু কিছু মানুষের নোংরা আচরণ আমাকে এই ভালোবাসা থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আর আমরা সিনিয়র থেকে শিখব। আপনাদের কাছ থেকে এমন খোঁচামার্কা কথা আশা করা যায় না। ভালো থাকবেন।’

ফারিয়ার বক্তব্যের পর ক্ষিপ্ত হয়ে ফেসবুকে লাইভে আসেন ২০০৬ সালের ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতার সেরা দশে থাকা নাফিজা জাহান। এরপর অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বিয়ে করে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন তিনি। নাফিজা বলেন, ‘একটি নিউজ দেখে সারা দিন সময় বের করার চেষ্টা করছিলাম। চাইছিলাম ফেসবুক লাইভে আসতে। কারণ, নিউজটি দেখার পর থেকে আমার গা কিটমিট করছিল, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

‘একজন আপা মিডিয়া নিয়ে তাঁর লাইফের ইতিহাস বলেছেন। মিডিয়া অনেক খারাপ! হ্যাঁ, মিডিয়া অনেক খারাপ। মিডিয়া যদি অনেক খারাপই হয়ে থাকে, মিডিয়ার মানুষজন যদি অনেক খারাপই হয়ে থাকে, তবে আপনি কেন মিডিয়াতে আসলেন?’

ফারিয়াকে ‘প্রিন্সেস ডায়না’ উল্লেখ করে নাফিজা বলেন, ‘আফা, বিশ্ব বিখ্যাত প্রিন্সেস ডায়না। যার কারণে সবাই তাঁকে কফি খাওয়ার জন্য, এই করার জন্য, সেই করার জন্য প্রস্তাব দেন। শোনেন, খারাপ-ভালো সব জায়গাতেই আছে। নিজেকে ম্যানেজ করার বিষয়টি শিখতে হবে। আপনি এক দিন হলেও মিডিয়াতে কাজ করেছেন। কিন্তু এখন আপনাকে কেউ কাজে নেয় না। আর এ জন্য আপনি মিডিয়াকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। আপনি যদি দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হতেন, তবে মিডিয়া নিয়ে মানুষের সামনে এতটা খারাপভাবে বলতে পারতেন না। আপনাকে যে কজন মানুষ চেনে, সেটা কিন্তু এই মিডিয়ার বদৌলতেই। ওপরের দিকে থুথু ফেললে সেটা নিজের শরীরেই পড়ে। পাবলিকের সামনে মিডিয়াকে খারাপ না করে আগে আমরা ভালো হই।’

‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতার ২০১০ সালের প্রথম রানারআপ মৌসুমী হামিদ বলেন, তিনি এক প্রযোজকের সঙ্গে ফারিয়া শাহরিনকে দেখেছেন কফি খেতে। এ কথা বলার পর মৌসুমী হামিদের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলেন ফারিয়া। সেখানে তিনি মৌসুমীর কাছে জানতে চেয়েছেন, তিনি কেন এই কথা বলেছেন। এরপর মৌসুমী হামিদের সঙ্গে ফারিয়ার কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফেসবুকে প্রকাশ করে দেন ফারিয়া।

তাতে দেখা যায়, মৌসুমীর উদ্দেশে ফারিয়া উত্তেজিত হয়ে লিখেছেন, ‘তুই লিখছস আমাকে নাকি কোনো প্রযোজকের সঙ্গে গ্লোরিয়াতে দেখছিস? আমিও একটু শুনি। কমেন্টটা করার জন্যই করছিস? নাকি আমার সঙ্গে তোর ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা আছে? আমারই মনে পড়তেছে না। বল তো কে? তাহলে আমিও শুনি।’

জবাবে মৌসুমী হামিদ বলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই, আপু। বাংলালিংক টিভিসি থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে পছন্দ করি। কারণ, তুমি খুবই সুন্দর। কিন্তু তোমার একের পর এক বিবৃতিতে আমাদের পরিবারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সবাই তো এক রকম না, আপি। তুমি কেমন তা আমরা যারা মিডিয়াতে কাজ করি, তারা তো জানি। তুমি কাউকে পাত্তা দাও না। এটা ভালো। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আমাদের পচা বলে, আপি। তোমার পরিবারের সামর্থ্য আছে, তুমি কাজ ছেড়ে দিয়ে বিদেশ পড়ো। সবার এই সামর্থ্য নেই। তাদের তো কাজ করে যেতে হয়। তুমি, আমি, আমরা সবাই তো এক, সহকর্মী।’

ফারিয়াকে নিয়ে সরাসরি এই কজন কথা বললেও অভিনয়শিল্পী ও প্রযোজকদের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে সমর্থন দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে আছেন নাদিয়া আহমেদ, শ্রাবণী ফেরদৌস, তুহিন বড়ুয়া, পল্লব বিশ্বাস, আলভী, জেনী, শশী, নওশীন, শ্যামল মাওলা, মৌসুমী নাগ, বাঁধন, তিন্নি, চয়নিকা চৌধুরী, মৌসুমী হামিদ প্রমুখ।

সহকর্মীদের কাছ থেকে তিরস্কার জুটলেও ফারিয়ার সাহসী বক্তব্যের প্রশংসা করেছেন অনেকে। তৌহিদ আহমেদের নামের একজন বলেছেন, ‘আপনার কথাগুলো অপ্রিয় সত্য। মিডিয়ায় কাজ করতে হলে অনেক মেয়েকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়, এটা ধ্রুব সত্য। পরিচালকের সঙ্গে আপস করতে হয়, প্রযোজকের সঙ্গে আপস করতে হয়, এমনকি নায়কের সঙ্গেও। এসব ঘটনা হলিউড-বলিউডে প্রতিনিয়ত ঘটেছে আর আমরা তো তাদেরই অনুসরণ করছি।’

আবদুল মইন নামের একজন বলেছেন, ‘আপনার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। বোঝা যায়, আপনার শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ এই সাহস জুগিয়েছে। যদি ওই সব লোকের নাম প্রকাশ করতেন, আরও ভালো হতো।’

সাক্ষাৎকারে ফারিয়ার সাহসিকতারও প্রশংসা করেছেন কেউ কেউ। তাঁদের একজন বলেন, ‘এই প্রথম একজন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বাংলাদেশের মিডিয়ার প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করলেন। যে কথাগুলো তিনি বললেন, তা নিদারুণ বাস্তব ও নির্মোহ সত্য। আমাদের বর্তমান মিডিয়া নারী কর্মীদের জন্য মোটেই আর নিরাপদ নয়। এ কারণেই প্রতিনিয়ত মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনা।’

পাকিজা মল্লিক লিখেছেন, ‘আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি এখনো কোনো কাজ করিনি। কিন্তু কাজ করার মানসিকতা নিয়ে নিজেকে তৈরি করছি। একটু একটু করে সামনের দিকে এগোচ্ছি, এই কথাগুলো আমিও শুনছি। মিডিয়ার বাইরের লোকদের কাছ থেকে এগুলো আশা করাই যায়। কিন্তু তাই বলে ভেতরের লোকদের কাছ থেকে যখন এসব শুনি, তখন নিজের ভেতরের স্পৃহাটা নষ্ট হয়ে যায়।’

সবশেষে আরও একবার ফারিয়ার মুখোমুখি হলে তিনি বলেন, ‘আমি যা বলেছি, তা নিতান্তই আমার অভিজ্ঞতা। আমার ভালো অভিজ্ঞতার বাইরে শুধু খারাপগুলো তুলে ধরেছিমাত্র। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এসব বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। অথচ এসব বলার পর সহকর্মীরা কোথায় আমাকে সাপোর্ট করবে, পাশে এসে দাঁড়াবে, উল্টো আমার বিরুদ্ধে সমালোচনায় মেতে যায়। অচেনা-অজানা অনেককে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফেসবুকে আপত্তিকর সব মন্তব্য করাচ্ছে। আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ আমার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা খুব দুঃখজনক। আমার সঙ্গে ডিরেক্টরস গিল্ড ও অভিনয়শিল্পী সংঘের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা এই বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ