বেক্সিমকো গ্রুপকে আবারও সুবিধা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: পুনর্গঠন করা ঋণও সময়মতো পরিশোধ করছে না বেক্সিমকো গ্রুপ। এ কারণে গ্রুপটিকে নতুন করে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর ফলে প্রথম দিকে শুধু সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এতে প্রতি কিস্তির পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেছে। এভাবে ঋণ পরিশোধ করতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সহমত জানিয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে বলেছে, ব্যাংকগুলো নিজেরাই বিদ্যমান মেয়াদের মধ্যে কিস্তি পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী, বেসরকারি খাতের এবি ও এক্সিম ব্যাংক গ্রুপটিকে এই সুবিধা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতে এ প্রক্রিয়া চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ব্যাংকিং ভাষায় ঋণ পরিশোধের এ সুবিধাকে বেলুন সুবিধা বলা হয়।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায় বেক্সিমকো গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকাসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। যার বেশির ভাগই এখন ঋণ পরিশোধ করছে না।
এখন খেলাপি হওয়া ঠেকাতে বেক্সিমকো গ্রুপকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। এর আওতায় প্রথম দিকে শুধু সুদের টাকা পরিশোধ করবে গ্রুপটি, পরে মূল টাকা শোধ দেবে বেক্সিমকো গ্রুপ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘সামনে নির্বাচন, এ কারণে অনেকেই খেলাপি থেকে মুক্ত থাকতে চাইছেন। এ জন্য নতুন ফন্দি করা হচ্ছে। যখন ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়, আমরা তখনই বলেছিলাম এসব অর্থ আদায় হবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।’
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, ‘পুরো সুদের পাশাপাশি স্থিতির ১০ শতাংশ অর্থ জমা নিয়ে কোনো গ্রুপকে এই সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কারণ পরে এসব অর্থ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’
এ বিষয়ে সালমান এফ রহমানের বক্তব্য জানতে জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট পিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সালমান এফ রহমান লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ঋণ পুনর্গঠনের পর থেকে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করে আসছে বেক্সিমকো গ্রুপ। কিন্তু নগদ টাকার প্রবাহ আশানুরূপ না হওয়ায় এ বছর শুধু সুদের টাকাটা পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে আবেদন করেছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। এ ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করা হয়নি। তাই যে সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোর টাকা পরিশোধের কথা রয়েছে, সেই সময়ের মধ্যেই সেটা করা হবে। বেক্সিমকো গ্রুপ নতুন করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়বে, যার মাধ্যমে ঋণ শোধ সহজতর হবে।’
সুবিধা দিল তিন ব্যাংক
ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান নিউ ঢাকা ট্রেডিং, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার ও বেক্সিমকো লিমিটেডের ৬১২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। ২০১৬ সালের ২৯ জুন এসব ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। ফলে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম কিস্তি দেওয়ার সময় হয়। প্রতি ত্রৈমাসিকে ৩২ কোটি টাকা কিস্তি হলেও ওই সময়ে গ্রুপটি ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করে।
গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান পৃথক আবেদনে জানায়, বর্তমান ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া গ্রুপটি অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। আগামী ১৮-২৪ মাসের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। ঋণের কিস্তি পুনর্গঠনসহ সুদ হার কমানোর আবেদন জানায় প্রতিষ্ঠান তিনটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো কিস্তি পুনর্গঠন করে প্রতি ত্রৈমাসিকে ২২ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। আগে যা ছিল ৩২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকও ২০১৬ সালে বেক্সিমকো লিমিটেডের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে। ১১ শতাংশ সুদ হারের ফলে প্রতি কিস্তি দাঁড়ায় ৪৩ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত পুরো কিস্তি পরিশোধ করেনি। এক বছরে ১১১ কোটি টাকা আদায় হয়। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি আবেদনে জানায়, বর্তমান ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ জন্য সুদ হার ৮ শতাংশ নির্ধারণ করে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ জুন পর্যন্ত শুধু ঋণের সুদ পরিশোধ করার সুযোগ চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপত্তি না থাকায় ব্যাংকটি ১০ শতাংশ সুদ হার নির্ধারণ করে কিস্তি পুনর্গঠন করে। এর ফলে ৮৪০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে প্রতি ত্রৈমাসিক কিস্তি দাঁড়ায় ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা। আগে যা ছিল ৪৩ কোটি টাকা। প্রথম ৮ কিস্তিতে শুধু সুদ পরিশোধ হবে। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষও বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
এদিকে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ২০১৬ সালে গ্রুপটির ২৩৮ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে। বেক্সিমকো সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করেনি। এরপরও গত ডিসেম্বরে কিস্তি পুনর্গঠন সুবিধা দেয়। ফলে এখন প্রতি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে ১৮ কোটি শোধ করতে হবে বেক্সিমকো গ্রুপকে। আগে যা ছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হায়দার আলী মিয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে গ্রুপটিকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।’
সবারই টালবাহানা
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে বিশেষ নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় ১১ শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, সুবিধা পাওয়ার এক বছর পর ঋণ পরিশোধের সময় এলে বেশির ভাগই নানা টালবাহানা শুরু করেছে। তারা পুনর্গঠন করা ঋণে আরও ছাড় চাইছে, আবার নতুন করেও আরও ঋণ চাইছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক এসএ গ্রুপ ও নারায়ণগঞ্জের বিআর স্পিনিং টাকাই পরিশোধ করেনি। আবার রতনপুর গ্রুপও পুরো কিস্তি পরিশোধ না করে নতুন করে সুবিধা চেয়েছে। অনেকেই আদালতের আশ্রয় নিয়ে খেলাপি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখছেন। সুবিধা পাওয়া অন্য গ্রুপগুলো হলো যমুনা, শিকদার, কেয়া, এননটেক্স, রতনপুর, এসএ, বিআর স্পিনিং, রাইজিং গ্রুপ ও আব্দুল মোনেম।
বড় গ্রুপগুলোর অনেকেই নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। প্রতিটি ব্যাংকে শীর্ষ ২০ জন করে খেলাপি গ্রাহকের কাছে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে আটকা পড়েছে ৩২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাবে নিলে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে।