এ নেশা টু্টব আমি কেমন করে ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রাতে মাথার কাছেই মুঠোফোন রেখে ঘুমানোর অভ্যাস ইমতিয়াজ আহমেদের। গত কয়েক বছরে এই অভ্যাস তৈরি হয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আগে একটু ফেসবুকে ঢোকা, হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা না বললে ভালো লাগে না। এটা করতে গিয়ে প্রতি রাতেই ঘুমাতে দেরি হয়ে যায়। অফিসে যাওয়ার জন্য সকালে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। আবার সকালে উঠে আগে মুঠোফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুঁ মারেন। সকালে ‘শুভ সকাল’ জানিয়ে কে কী পোস্ট দিল, দেখতে বেশ লাগে। নিজের স্ট্যাটাসের লাইক-কমেন্টও একটু দেখে নেন।
শাহনাজ পারভীন ছোট বোনের চাপাচাপিতে তিন বছর আগে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। শুরুতে তত ভালো না লাগলেও এখন ফেসবুক ছাড়া কোনো কিছু ভালো লাগে না। বাসায় ওয়াইফাই লাইন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। একই সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে ইন্টারনেটও সারাক্ষণ চালু থাকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুঠোফোন থেকে শুধু ঢুকে পড়লেই হয়।
এই দুজনের মতো এত স্বাধীনতা না থাকলেও মুঠোফোন থেকে দেদারসে বন্ধু বানিয়ে চলছে তরুণ রাফসান। বাবা-মা এ নিয়ে বকাঝকাও কম করেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সময়ে-অসময়ে বুঁদ হয়ে থাকে সে মুঠোফোনে। শুধু ফেসবুক? তার মুঠোফোনে রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেও এই আসক্তি চলে এসেছে। মাদকাসক্তির উপসর্গ আর ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপসর্গগুলো প্রায় কাছাকাছি। শুরুতে প্রত্যেকে এতে সময় কম দিলেও ধীরে ধীরে সময় কাটানোর পরিমাণ বাড়তে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিমুহূর্তে আপডেট পাওয়া যায় বলে বারবার এতে উঁকি দেওয়ার আগ্রহ থেকে যায়। এই আসক্তিকে এখনো মনোরোগ হিসাবে শনাক্ত না করলেও বিশ্বব্যাপী বিষয়টি খুব উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। এই জানুয়ারিতেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ভিডিও গেমিং আসক্তিকে রোগ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে (এসএনএস) অংশগ্রহণের মাত্রা যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে তা রোগ হয়েছে শনাক্ত হলে অবাক হওয়ার কিছু হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিদিন চেম্বারে এমন আসক্তি নিয়ে আসা রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের বেশির ভাগই কিশোর। মাদকের নেশার ক্ষেত্রে যে ধরনের আসক্তি দেখা যায়, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির ক্ষেত্রেও উপসর্গগুলো কাছাকাছি। এক রোগীর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ওই কিশোরের ট্যাবের প্রতি আসক্তি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে বাবা-মা তার ট্যাব কেড়ে নেওয়ার পর সে দুই হাতে কেটে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আসক্তির কারণে এই শিশু-কিশোর কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেতে চায় না। অনেকে রাত জেগে এসএনএসে সময় দিয়ে দিনে ঘুমায়। প্রযুক্তিতে কিছু উপাদান আছে, যা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিশ্বে মানসিক চিকিৎসকদের সংগঠন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তিকে এখনো রোগ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এটা এখন চিকিৎসার জন্য মনোযোগ পাওয়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং এর ওপর নজরদারির প্রয়োজন আছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আরেক সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিদিন অনেক রোগী আসে, যারা এ ধরনের আসক্তিতে ভোগে। এর মধ্যে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যাই বেশি। তাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণও কম থাকে। মাদকসক্তদের ক্ষেত্রে নিরাময়ের জন্য যেমন হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়। এসএনএসে আসক্তির শিকার ছেলেমেয়েদেরও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।’ তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, তা আনন্দ অনুভূতি পেতে মস্তিষ্কের স্নায়ুতে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাদকদ্রব্য শুরুতে নিলে যতটা আনন্দ হতো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমাণ বাড়াতে হয় সেই আনন্দ পেতে। এ ক্ষেত্রেও তাই। এসএনএসে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে জেনেও অনেকে এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। জীবনের স্বাভাবিক উপাদান থেকে আনন্দ নিতে বিচ্যুত হয়ে ভার্চ্যুয়াল জগৎমুখী হচ্ছে তারা।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সচিব ও মুখপাত্র সরওয়ার আলম বলেন, গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাব অনুসারে দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৬ লাখ। এর মধ্যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (আইএসপি) মাধ্যমে ৫৩ লাখ গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল ডেটার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। আর এসএনএসের মধ্যে ফেসবুকে নিবন্ধিত ব্যক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ। তবে তারা সবাই সক্রিয় নয়।
গত বছর সোশ্যাল মিডিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান উই আর সোশ্যাল ও হুটস্যুট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে। বিশ্বের প্রায় ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ৩৭৭ কোটি; আর তাদের মধ্যে ২৭৮ কোটি ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সক্রিয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির ওপর গত সপ্তাহে বিবিসি অনলাইন নিজেদের করা এক জরিপের ফলাফল তুলে ধরে জানায়, এই জরিপে ৫৫৪ জন অংশ নেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ মনে করেন, এসএনএসে দুই-তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করা বাড়াবাড়ি। তবে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, প্রতিদিন এতে একজন কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ১৫ বছর বয়সী কিশোরেরা গড়ে ছয় ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই সময়ের মধ্যে বেশির ভাগটাই তারা ব্যয় করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন সাইটে। নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির মার্ক গ্রিফিতসের গবেষণা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার জুয়া খেলা ও ইন্টারনেট আসক্তির চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ধূমপান, মদ ও মাদকের প্রতি আসক্তির ক্ষেত্রে যেসব উপসর্গ দেখা যায়, তার সবই এ ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মনমেজাজ বদলে যাওয়া থেকে শুরু করে হতাশায় ভোগা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া মার্ক গ্রিফিত ও ডারিয়া কুসের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বহির্মুখী ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে নিজের মূল্যায়ন বাড়াতে এবং অন্তর্মুখী ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে খেসারতের অংশ হিসেবে এসএনএসে ঝুঁকছেন। তাঁরা বাস্তব জগতে মানুষের চেয়ে এখানেই সময় দিচ্ছেন বেশি।
এই পরিস্থিতিতে ভার্চ্যুয়াল জগতের বাইরে বাস্তব জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, হতাশা থেকে বাঁচতে অনেকে এসএনএসের আশ্রয় নেয়। এতে হিতে বিপরীত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণত মানুষ আনন্দের বিষয়গুলো প্রকাশ করে। এসব দেখে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেকে বঞ্চিত ভেবে আরও হতাশ হয়।
মেখলা সরকারের মতে, হতাশা কমানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আশ্রয় করা একটি ভুল প্রক্রিয়া। আমরা অনেক সময় নিজেদের দুঃখ-কষ্ট মোকাবিলা করার চেষ্টা করি ভুল পদ্ধতিতে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে জরুরি। মাঝে মাঝে এক-দুই দিন তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। রাত ১২টার পর কোনো অবস্থাতে এসএনএসে প্রবেশ করব না—এমন দৃঢ়তা থাকতে হবে।
তবে প্রযুক্তি বিকাশের এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরত না রেখে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর জোর দিতে বললেন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব ও মুখ্য নির্বাহী টি আই এম নুরুল কবির। তিনি বলেন, শুধু নেতিবাচক দিক দেখলে হবে না। এসএনএস ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার আগে এর সঙ্গে জড়িত নানান ব্যবসার প্রসারের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আর্থ-সামাজিক প্রভাব এড়ানোর সুযোগ নেই। মানবিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও এর অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।