শেষ সময়ে কেন ইভিএম ?
বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,
ঢাকা (৩০ আগস্ট ২০১৮) : নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে আসা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন শেষ সময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমের বিষয়টি সামনে এনে নতুন বিতর্ক তৈরি করছে। যদিও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে।
ইসিও এত দিন বলে এসেছে, সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি বা কারিগরি সামর্থ্যও এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। এই সময়ে ইসি কেন বা কার স্বার্থে ইভিএম নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে। এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনতে হবে। আরপিও সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব করতে যাচ্ছে ইসি। এ লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসবে কমিশন। কমিশন অনুমোদন দিলে তা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। এরপর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন শেষে তা পাসের জন্য সংসদে পাঠানোর বিধান রয়েছে।
এদিকে আরপিও সংশোধনীর প্রস্তাব পাঠানোর আগেই ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। তবে তড়িঘড়ি করে নেওয়া এই প্রকল্প প্রস্তাবের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তাদের মতামতে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
ইসি সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য ভোটকক্ষ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার। সব আসনে ইভিএমে ভোট নিতে হলে ২ লাখ ৬৪ হাজার ইভিএম প্রয়োজন হবে (প্রত্যেক কেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত ইভিএমসহ)। আর যদি ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হয়, তাহলে ১ লাখ ৩২ হাজার ইভিএম প্রয়োজন হবে।
ইভিএম কেনা ও অল্প সময়ের মধ্যে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে খোদ ইসিতেই প্রশ্ন আছে। নির্বাচন কমিশনারদের কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে ইভিএমের আলোচনা সামনে আনা বা বিপুলসংখ্যক ইভিএম ক্রয় করা অনাবশ্যক। এতে বিতর্ক বাড়বে। কারণ ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিমত যেমন আছে, তেমনি ভোটারদের অনেকের অনীহাও আছে এবং এটা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল নেই।
দেশে ইভিএমের প্রচলন করেছিল এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তখনকার নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন গতকাল মঙ্গলবার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি। এর মধ্যে এতগুলো ইভিএম কেনা, আইন সংশোধনের উদ্যোগে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার ভালো। তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ভোটারদের ইভিএমের ব্যবহার শেখানো এবং জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা জরুরি। এ নিয়ে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এসব করতে অনেক সময় লাগবে।
হঠাৎ তোড়জোড়
গত বছরের জুলাইয়ে ঘোষিত ইসির কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে আসা বিভিন্ন সুপারিশের আলোকে এই আইন সংস্কারের কথা ছিল। এ জন্য গঠিত ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি আরপিওর ৩৫টি ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে নির্বাচন কমিশন এ প্রস্তাব আরও পর্যালোচনার জন্য ফেরত পাঠায়। তারপর ওই উদ্যোগ থমকে যায়। গত ১৫ জুলাই ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, আরপিও সংশোধনের একটা উদ্যোগ আগে নেওয়া হয়েছিল। তবে সেটা এখন আর হচ্ছে না।
ইসি সচিবের ওই বক্তব্যের এক মাসের মাথায় ইসি আবার আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে ২৬ আগস্ট একটি বৈঠক করে ইসি। ওই বৈঠক ৩০ আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। ইসি সূত্র জানায়, আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি যে ৩৫টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছিল, তার মধ্যে বাকি সবগুলো বাদ রেখে এখন কেবল ইভিএমে ভোট নেওয়ার বিষয়টি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করার চিন্তা করছে।
ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব পক্ষ একমত হলে জাতীয় সংসদেও ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে। এ জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আরপিওতে সংযোজন হবে কি না,৩০ আগস্ট ইসির সভায় সে সিদ্ধান্ত হতে পারে। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও ভোটারদের প্রশিক্ষণ, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ অনেকগুলো বিষয় আছে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে কত আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, তখন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা ইসির নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে ইসির সিদ্ধান্ত ছিল যেকোনো একটি পৌরসভার সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। এরপর সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানো হবে। কিন্তু বর্তমান কমিশনের অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদেও পুরোপুরি ইভিএমে ভোট হয়নি।
এই অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো সবচেয়ে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। যদিও ইসির কাছে এত বিস্তৃত আকারে ইভিএম ব্যবহার করার মতো দক্ষ জনবল নেই।
এ বছর অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কয়েকটি করে কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তা করতে গিয়েই ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছে। পাঁচটি সিটির মধ্যে বরিশালে সবচেয়ে বেশি, ১১টি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এখানে ইসির ৩৬ জন কর্মকর্তা দুই দিন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন। এ ছাড়া ইভিএম প্রদর্শন, ভোটিং শিক্ষা ও জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মোট ৯৯ জন কর্মকর্তা তিন দিন ধরে কাজ করেন। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার বাইরে অন্তত তিনজন করে কারিগরি কর্মকর্তা রাখতে হয়েছে। তারপরও কয়েকটি জায়গায় কারিগরি ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণে সমস্যা হয়েছে। অনেক ভোটার এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি।